খাদ্যান্বেষী ৬
“ফ্রেশ-শ-শ” পর্ব: ১০ই জুন, শুক্রবার, স্থানীয় সময় ১৬:৪৩, স্টকহোম-দুবাই উড়ান:
“ম্যাডাম, আর ইউ ফ্রম ইন্ডিয়া?” — ঈষৎ ঝুঁকিয়া অভিবাদন করিয়া হাসিমুখে প্রশ্ন করিয়াছিল লোকটি। কোন লোকটি? স্টকহোমে আমি যে হোটেলে উঠিয়াছিলাম, তাহার ব্রেকফাস্ট বুফের দায়িত্বে বেশ কয়েকজন শ্বেতাঙ্গীর মাঝে উপমহাদশীয় চেহারার একমাত্র যে মানুষটি থাকিত, সে। উত্তর শুনিয়া খুশি হইয়া জানাইয়াছিল যে সে বাংলাদেশের মানুষ।
তাহার সাথে বেশি কথা হয় নাই। ইহাদের ব্রেকফাস্ট মেনুটি অতি জবরদস্ত ছিল। অফিসের জন্য বাহির হইবার পূর্বে দৈনিক চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ মিনিট ব্যয় করিয়া যথাসম্ভব মনোযোগ দিয়া সেই মেনুর রসগ্রহণ করিবার চেষ্টা করিতাম। মধ্যে মধ্যে স্বগৃহে কল ব্যতীত আর দ্বিতীয় কিছু সেই ধ্যানে ব্যাঘাত ঘটাইতে পারিত না।
হ্যাঁ, ইহা বড় আফসোসের কথা, যে তাহার সাথে সত্যই আর কথা হইল না। শুধু সহাস্য সুপ্রভাত বিনিময় হইল প্রতিদিন। তাহার গল্প শোনা হইল না। কিন্তু শোনা হইয়াছে আরো বেশ কিছু মানুষের গল্প। বড় বিচিত্র তাহাদের পটভূমি। যদি সময় করিয়া উঠিতে পারি, সেই সব গল্প শোনাইব নিশ্চয়ই।
যাহা হউক, আমি খাদক মানুষ, এক্ষনে খাদ্যের কথায় আসি। সুইডেনের রাজধানী শহরের একটি সুন্দর হোটেলের ভারী সুন্দর প্রাতরাশের কথায় আসি। এমন প্রাতরাশ, যাহার জন্য ঘড়ি ধরিয়া ৬টায় উঠিয়া স্নান করিয়া ফেলা যায়, তাহার গল্পে আসি।
আমিষের মধ্যে এত ধরনের সসেজ, হ্যাম, বেকন, সালামি প্লেটে লইয়া পাশাপাশি সাজাইয়া খাইয়াছি কি আগে? খাইয়াছি, লন্ডনের একটি চার তারা হোটেলের ব্রেকফাস্ট বুফেতেই খাইয়াছি — সাড়ে সাত বছর পূর্বের একটি সকালে। কিন্তু ঈশ্বরণের সহিত গল্প করিবার দায় ছিল সেদিন, খাদ্যে সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করিতে পারি নাই। যোগীর ন্যায় মৌনব্রত অবলম্বন করিয়া মগ্ন হইয়া খাইলে তেলেগু ছেলেটি মনঃক্ষুন্ন হইত হয়ত।
তাহার উপর, মনের যত প্রসার এক্ষনে ঘটিয়াছে, তখনও ঠিক ততটা ঘটে নাই। আমিষ পাতে তুলিবার আগে বড় হিসাব করিতে হইত, ভারতীয় মান অনুযায়ী যথেষ্ট রকমের সুপক্ক (অর্থাৎ ভাজা ভাজা) উহা হইয়াছে নাকি। আমিষের স্বাভাবিক লালচে বা গোলাপী বর্ণ উহাতে বর্তমান নাকি। থাকিলে খাইব না।
এক্ষনে খাই। ভাল লাগিতেছে কিনা চাখিয়া দেখি। এক্ষনে বুঝিয়াছি, পৃথিবীতে রন্ধনপ্রণালী প্রচুর আছে। খাদ্যের প্রকৃত স্বাদ-বর্ণ-গন্ধকে পূর্ণ সম্মান দিয়া, উহাদের যথাসম্ভব ধরিয়া রাখিয়া সুপক্ক আহার রাঁধিবার কৌশল ভারতে প্রচলিত নহে, কিন্তু পাশ্চাত্যে উহা শিল্পবিশেষ। জানিয়া শুনিয়া liverpastej বা লিভার পাটের স্বাদ গ্রহণ করিবার হিম্মত আগে ছিল কি? ছিল না। এক্ষনে আছে।
এবার আসি নিরামিষ কথায়। পৃথক পৃথক বোলে ভর্তি শশা, টম্যাটো, রঙ্গীন ক্যাপসিকাম, ফল ও দারুন সতেজ শাকপাতার পার্শ্বে উহারা কি? উহারা হার্ব (herb)। উহারা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র টবে মৃত্তিকার সহিত পূর্ণ উদ্ভিদরুপে বিরাজমান। ধারাল কাঁচি সন্মুখে রাখা, পত্র কাটিয়া প্লেটে সাজাইয়া লউন। তাকাইয়া দেখুন, উহাদের মধ্যে ছোট্ট দুইটি ধনে গাছও আছে।
— — — — — — — — — — — — — -
সখা, “ফ্রেশ-শ-শ” কাহারে কয়?
সেকি এমনি মহিমাময়?
— — — — — — — — — — — — — -
দই খাইয়াছি প্রচুর। ন্যাচারাল ইয়গার্ট। ফ্লেভার্ড ইয়গার্ট। উপরে গ্রানোলা, নানাবিধ বীজ, বা টাটকা রসালো বেরি ছড়াইয়া খাইয়াছি। সুন্দর সবুজ অলিভ খাইয়াছি কত। সাবওয়ের শুকনা অলিভ হইতে এইবারে বুঝি মন উঠিল আমার। খাইয়াছি প্রচুর পরিমাণ আপেল ও কমলা লেবুর রস। কেক। চিজ। চকলেটের গুঁড়া ছড়াইয়া কফি।
আর ট্যারা চোখে তাকাইয়া কাটাইয়া গিয়াছি রকমারি ব্রেড গুলিকে। উচ্চতা (মারিয়া ও কাটিয়া) ৫ ফুট ৩ ইঞ্চি। উদরে স্থান সীমিত। বাছিয়াবুছিয়া খাইতে হইবে না?
আজিকার মত ঝুলি গুটাইব আরো একটি মানুষের কথা বলিয়া। যে ট্যাক্সিচালক মানুষটি আমাকে আর্লান্ডা বিমানবন্দর হইতে হোটেলে পৌঁছাইয়া দিল স্টকহোম পৌঁছিবার দিন, ইহা তাহার কথা। উচ্চতা, গঠন, বর্ণ দেখিয়া তাহাকে আমি ইউরোপিয়ান বলিয়া ভুল করিয়াছিলাম। ক্রমে ক্রমে জানিতে পারিলাম, সে ইরাকের কুর্দিস্তানের মানুষ। আঠাশ বছর আগে দেশ ছাড়িয়া আসিয়া সে সুইডেনেই রহিয়া গিয়াছে। আরো ক্রমে ক্রমে জানিতে পারিলাম, সে “আপ ক্যায়সে?” জানে। “লড়কি খুবসুরত” জানে। শাম্মী কাপুর, সঞ্জীব কুমার, আশা পারেখ, হেমা মালিনী, ঋষি কাপুর, দিলীপ কুমার জানে। জানিলাম, তাহার স্কুলজীবনে সে ও তাহার কুর্দ বন্ধুগন প্রত্যহ একে অপরকে মাপিত নতুন কি হিন্দি শব্দ শিখিয়া আসিয়াছে তাহা দিয়া। আঠাশ বছর ধরিয়া সুইডেনে সে হিন্দি সিনেমা পায় নাই, তবু তাহার শৈশবের তারকাদের সে ভোলে নাই। তাহাদের কথা বলিতে গিয়া তাহার কণ্ঠে উৎসাহের বান ডাকে।
— — — — — — — — — — — — — -
সখা, সংস্কৃতি কারে কয়?
তারে বাঁধিয়া রাখা যে দায়…
— — — — — — — — — — — — — -
লেখা ও ছবি: নিজস্ব
আগের পর্ব: খাদ্যান্বেষী ৫. Food blog by a hungry hippo on an… | by Antara Kundu | Aug, 2022 | Medium