খাদ্যান্বেষী ৭

Antara Kundu
4 min readAug 29, 2022

--

এটাসেটামিক্স পর্ব: ১৫ই জুন, বুধবার, সময় ১২:৫৭, বেঙ্গালুরুর স্বগৃহ:

Photo by me!

গত শনিবার স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করিয়াছি। দেড় বর্ষীয় কনিষ্ঠ পুত্রটি বড় খুশি হইয়াছে। অদ্যাবধি “মাম্মা, মাম্মা” ডাকিয়া ক্রোড়ে ঝুলিয়া থাকিতেছে সুযোগ পাইলেই। “হানি আনিতে বেই বেই যাইতেছি” — বলিয়া গিয়াছিলাম উহারে। মধু, চিনি ও অন্যান্য সকল সুমিষ্ট দ্রব্যাদি তাহার বড় প্রিয়, এবং উহারা সকলই তাহার ভাষ্যে ‘হানি’। উহাদের সরবরাহ অক্ষুণ্ণ রাখিতেই যে আমার ভ্রমণ, ইহা জানিয়া সে গমনকালে অতি ভদ্রভাবে টাটা জানাইয়াছিল আমারে। ফিরিয়া দেখিলাম, সে হানির কথা ইতিমধ্যে বিস্মৃত হইয়াছে। ছয়টি দিন উহার পিতা আগলাইয়া রাখিয়াছিল উহারে — এক্ষণে, আমাতেই তাহার সন্তুষ্টি। আহা, সোনাটি মম!

জেষ্ঠ্য পুত্রটি ষষ্ঠ বর্ষীয়। সে খুশি হইয়াছে সুইডিশ চকোলেটগুলি দেখিয়া। এই সাড়ে চার দিনে সে ও তাহার পিতা মিলিয়া প্রায় সবগুলি সাবড়াইয়াছে। বন্ধুবান্ধবদের জন্য কিছু বাঁচাইয়া রাখিবার কথা ভাবিয়াছিলাম। সে চেষ্টা নিষ্ফল হইবেই বুঝিয়া আমিও কিছু সাবড়াইয়াছি।

এই সুযোগে জানাইয়া রাখি — ‘চকোলেট কভারড অরেঞ্জ পিল’ (অর্থাৎ চকোলেট-আবৃত কমলালেবুর খোসা) খাইতে বড় ভাল। সংগ্রহ করিতে পারিলে খাইবেন। ‘চকোলেট ট্রি ‘ ব্র্যান্ডেরটি আমি পরখ করিয়া দেখিয়া লইয়া আসিয়াছিলাম। সকলেরই ভাল লাগিয়াছে। Fjäderholmarna দ্বীপে (উচ্চারণ জিজ্ঞাসিয়া লজ্জা দিবেন না) একটি হ্যান্ডমেড চকোলেটের দোকানেও এই বস্তু পাইয়াছিলাম — উহা আমি ও এলাইন মিলিয়া ওই স্থানেই খাইয়া শেষ করিয়াছি। এলাইন আমার সহকর্মী, স্টকহোম অফিসে কর্মরতা, ভারী ভাল মেয়ে। প্রচুর হাঁটিতে, চকোলেট খাইতে, ও আলাপ করিতে ভালোবাসে। আমাকে পুরা দ্বীপ ঘুরাইয়া দেখাইয়াছে।

যাহা হউক, চকোলেটের কথা তো হইল, কিন্তু এটাসেটামিক্স-এর কথা বলিয়াছি কি আপনাদিগকে? বলি নাই এখনো? তাহলে বলি?

স্টকহোম অফিসটিতে প্রথম যেই দিন যাইলাম, মঙ্গলবার, মধ্যাহ্নভোজের সময় আসিতে ইতিউতি চাহিতেছিলাম। রেস্তোরাঁয় যাইব কিনা, কোন রেস্তোঁরাটিতে যাইব, অদ্য থাইফুড খাইলে কেমন হয়, এইসবই ভাবিতেছিলাম। ডেব্রা আসিয়া বলিল — “আমার সহিত আইস। আমরা লাঞ্চ কিনিয়া অফিস ক্যান্টিনে আনিয়া একসাথে বসিয়া খাইয়া থাকি। তোমারে দেখাইতেছি, চল।”

লহিয়া গেল যে দোকানটিতে, তাহার নাম খুব সম্ভবত Hemköp। সেই স্থানে তিনটি সারিতে সাজানো রহিয়াছে অন্তত ১২-১৪টি রেকাবি। রেকাবিতে রহিয়াছে নানাবিধ সুপক্ক মাংস, নানাবিধ সালাদ, বিন্স, আলু, পিঙ্গলবর্ন চাউল ও ডিপ। আপনি ইউজ-অ্যান্ড-থ্রো প্লেট তুলিয়া লইবেন। ইচ্ছামতন রেকাবি হইতে ইচ্ছামতন পরিমাণ খাদ্য তুলিয়া ইচ্ছামতন মিশাইয়া (অথবা না মিশাইয়া) প্লেট সাজাইবেন। তারপর কার্ডের দ্বারা অটোমেটিক চেক আউট করিবেন। দাম ধার্য হইবে কিরূপে? আপনার প্লেটটির ওজনের হিসাবে। কেহ দেখিবে না প্লেটে কি আছে। দেখিবে কি, দেখিবার লোক-ই নাই কাউন্টারে!

বিস্মিত হইয়া বলিলাম — “এত ধরনের খাদ্য রহিয়াছে, ইহাদের তো বাজার মূল্যের অনেক তারতম্য হইবে, ডেব্রা! ইহারা কিরূপে ওজন দেখিয়া মূল্য নিরূপণ করিতেছে!”

ডেব্রা মুচকি হাসিয়া কহিল “দ্য সিক্রেট ইজ, ইউ টেক লেস অফ পটেটোজ, অ্যান্ড মোর অফ মিট! সিম্পল!” অর্থাৎ কিনা, আলুর দিকে কম তাকাইয়া মাংস বেশি তুলিবে, না হইলে তুমি মাংসের দামে আলু খাইয়া মুরগী হইবে। সিম্পল-ই বটে! সত্য, লোকবল কম থাকিলে ঘিলু হইতে অনেক বুদ্ধি বাহির হয়। ভারত হইলে শুধু কাউন্টার কেন, প্রতিটি রেকাবির পশ্চাতে একটি করিয়া মানুষ হাতা লইয়া দাঁড়াইয়া রহিত। অথচ সপ্তাহের প্রতিটি দিবসে মানুষকে বৈচিত্র্যময় লাঞ্চ পরিবেশন করিতে ও তাহার মূল্য গণিয়া লইতে ইহাদের শেফ ব্যতীত প্রায় কারুকেই প্রয়োজন হয় নাই।

এইবারে আপনি মনে মনে একটি পুস্তিকা খুলুন দেখি? পৃষ্ঠার উপরে বড় করিয়া লিখুন “লোকবল কমিলে উদ্ভাবনশক্তি বাড়ে — ইহা সত্য না মিথ্যা?”। তাহার পর পরিষ্কার হস্তাক্ষরে অনধিক ৬০০ শব্দে মতামত ব্যক্ত করুন। আমি কিছুই বলিব না, শুধু অপর একটি উদাহরণ দিব -

গত বৎসরের প্রথমভাগে বেশ কয়েকটি মাস যাবৎ আমরা নিতান্ত লোকবলহীন ছিলাম। কোভিডের আশঙ্কায় বেঙ্গালুরুর সমস্ত বড় বহুতলগুলিতে বাহিরের মানুষের গমনাগমন বন্ধ করা হইয়াছিল। অতএব রান্না ও ঘরের কাজ সামলাইবার কোন সাহায্যকারী আমাদের ছিলনা।

জেষ্ঠ্যটি তখন পঞ্চবর্ষীয়, সে খাওয়াইয়া না দিলে থালা লইয়া বসিয়া থাকে। হাঁ করিয়া টিভি দেখে, টিভি না পাইলে দেওয়াল, ছাদ ও বাতাস দেখে, তাহার পর টেবিল ছাড়িয়া উঠিয়া যায়। কনিষ্ঠটি নিতান্ত নবজাতক, মাতৃত্বকালীন ছুটিতে থাকিলেও তাহাকে লইয়াই আমার বড় ব্যস্ততা তখন। স্বামী অফিস করেন গৃহ হইতে, তাহার সঙ্গে আমাকে সর্ব কার্যে যথাসম্ভব সাহায্য করেন। বড়টিকে তিনবেলা ধরিয়া পাকড়াইয়া খাওয়াইবার ফুরসত কাহারো নাই।

বকিয়া, বুঝাইয়া ও পিটাইয়া যখন তাহার ত্যাঁদরামো বন্ধ হইল না, তখন স্বামী একটি মোবাইল অ্যাপ ডেভেলপ করিলেন, করিয়া একটি পুরাতন স্মার্টফোনে উহা ডিপ্লয় করিলেন, করিয়া উহা জেষ্ঠের হাতে ধরাইলেন।

সেই অ্যাপ কি করে? না, উহা ৬০ সেকেন্ড হইতে কাউন্টডাউন করে, এবং ২০ সেকেন্ডে আসিয়া রক্তিমবর্ণ ধারণ করিয়া বিপ-বিপ ধ্বনি তোলে। অর্থাৎ মুখের গ্রাস শীঘ্র গিলিয়া, টাইমার রিসেট করিয়া, পরের গ্রাস লইবার সময় হইয়াছে। তাহাকে বলা হইয়াছিল, যে টাইমার একবার শূন্যে আসিয়া পড়িলে গৃহের টিভিটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বরাবরের মত বন্ধ হইবে। তিনবার শূন্যে আসিলে ফোন হইতে বেঙ্গালুরু মিউনিসিপ্যালিটির নিকট সংবাদ প্রেরিত হইবে। তাহারা আসিয়া গৃহ হইতে কাহাকেও ধরিয়া লইয়া যাইবেন, জেলে পুরিবেন।

জাদুর মতন কাজ হইয়াছিল, বিশ্বাস করুন, অন্তত মাস দুয়েক! তাহার পর সম্ভবত আমাদের ঢপটি লইয়া সে সন্দেহপ্রবণ হইয়া পড়ে, পুনঃ-উদ্ভাবনের সময় আসে।

যাহা হউক, আমি এতদ্বারা আপনাদিগকে কিছুমাত্র প্রভাবিত করিতেছি না। বিতর্কধর্মী রচনা সর্বদা খোলা মন লইয়া লিখিতে হয়। আহা, কতদিন এই ভাবে লিখেন নাই বলুন তো?

লিখিতেছেন তো?

লেখা ও ছবি: নিজস্ব

আগের পর্ব: খাদ্যান্বেষী ৬. Food blog by a hungry hippo on an… | by Antara Kundu | Aug, 2022 | Medium

--

--

Antara Kundu
Antara Kundu

No responses yet