স্বপ্নবীজ

Antara Kundu
5 min readJul 3, 2023

আলোর মত, ভালোর মত, মেঘের মত মন,
এক চোখে তার পরাগ মাখা, আরেক চোখে পণ,
এই দিকে টান, ওই দিকে টান, মনের বাড়ি কই?
কাজ ফুরানোর দিনের তরে আর কত তর সই?
……………………………………………………….

এই বছর ফেব্রুয়ারি মার্চে তিন তিন খানা বই শেষ করলাম, জানেন! হালকাপলকা বই কিন্তু একটাও নয়। একটা ৪৩২ পাতার, একটা ২১৬ পাতার, আর একটা ২৪৪। কন্টেন্টের হিসেবে দেখলে আরো ভারী ব্যাপারস্যাপার! শেষ করে দিল যে কি পরিমাণ খুশ হল কি বলব! যেন পড়ে/শুনে/দেখে নয়, নিজে _লিখে_ শেষ করেছি বইগুলো!

কি ভাবছেন — এত নাচানাচির আছেটা কি? তাহলে একটু ‘বিহাইন্ড দ্য সিনস’ নিয়ে যাই?

প্রথম বইটির নাম Empowered। লেখক Marty Cagan উইথ Chris Jones। এটি প্রোডাক্ট লিডারশিপের বই। প্রোডাক্ট টিম বা অর্গানাইজেশন বিল্ডিংয়ের সাথে জড়িত না থাকলে আপনার ওই কচকচিতে ঢোকার দরকার নেই। আমাকে ঢুকতে হল, কারণ গত এপ্রিলে আমি জব চেঞ্জ করেছি। এবং ঢোকার পরে পরেই নতুন কোম্পানির নতুন ম্যানেজার আমাকে পড়ে শেষ করার জন্য ২০-২৫ টি বইয়ের লিস্টি দিয়েছেন। Empowered তার মধ্যে অন্যতম, মানে হাইলি রেকমেন্ডেড।

বিশ্বাস করুন, এপ্রিল থেকে অক্টোবর অব্দি লিস্টি নিয়ে হাঁ করে বসে ছিলাম! নতুন অফিস, ভয়ংকররকম নতুন বিজনেস ডোমেন, পিলে চমকে দেওয়া দায়িত্ব, নতুন নতুন সহকর্মী, নতুন পলিটিকস, জ্যেষ্ঠপুত্রের কোভিড-পরবর্তী স্কুলজীবনের নতুনরকম শিডিউল, কনিষ্ঠপুত্রটির বিটকেলে দুরন্তপনা, আর দুই পুত্রের ঘন ঘন জ্বরের ঘনঘোর খিচুড়িতে জর্জরিত হয়ে আমার একটি বইও শুরু করা হয়নি অক্টোবর অব্দি। পড়া যে দরকার সেটা বুঝছিলাম বিলক্ষণ, কিন্তু আমার ২৪ ঘণ্টায় এদেরকে কোথায় আঁটাব সে ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছিলাম না।

উদ্ধার করলেন স্বামী। “বই যদি পড়িতে নাহি পারো, তবে শ্রবণ কর। Audible নামক অ্যাপে নিমজ্জিত কর নিজেকে।” — উনি বললেন। আগেও বলেছেন বহুবার। পাত্তা দিইনি। চোখের সামনে পাতা মেলে না ধরতে পারলে বই হজম হয় নাকি?

উনি বললেন হয়। ওই, আগেও বলেছেন বিস্তর। ভদ্রলোক নিজেও হজম করে থাকেন গাদা গাদা বই — টেকনিক্যাল, সায়েন্স ফিকশন, নভেল, কবিতা, বাংলা, ইংরিজি…। স্বামী যদি ছানাদের খাওয়ানো-দাওয়ানো, ঘুম পাড়ানোতে আপনাকে রেগুলার বেসিসে টেক্কা দ্যায়, এবং সাথে চাকরিবাকরি করে এক গাদা করে বই কেনে আর পড়ে, তাহলে আপনার ওয়ার্কিং মাদার হিসেবে প্যানপ্যান করার শক্তপোক্ত গ্রাউন্ডটা নেহাত পানসে হয়ে যায়। ।

এ হেন দশভূজ দুর্গাপদ স্বামীর ঘর করতে গেলে যে পিয়ার প্রেসার প্রুফ চামড়া দরকার, সে চামড়া আমি গজিয়ে নিয়েছি বছর দশেক আগে। কিন্তু যে অতি ভদ্র ম্যানেজার-কাম-মেন্টরটি প্রতি হপ্তায় অনেক আশা নিয়ে জুলজুল করে তাকান জুমকলের স্ক্রিন থেকে, তাকে বারেবারে নিরাশ করতে দুঃখই লাগে কেমন। অতএব Audible ইনস্টলড হলেন ফোনে। ওয়্যারলেস হেডফোন ডেলিভারড হলেন বাড়িতে। এবং আমার ৪০ মিনিটের দৈনন্দিন প্রাতঃভ্রমণে পাখির কলকাকলির বদলে Marty Cagan-এর কণ্ঠ আমার সঙ্গ দিতে শুরু করলেন।

সেই বই শুনে শুনে, কনসেন্ট্রেশন ইতিউতি ভাগলে আবার করে শুনে, পুরো চ্যাপ্টার শেষ হওয়ার পর “এই, কি হল ঠিক কেসটা?” মনে হলে আবার শুনে, শেষ হল এই ফেব্রুয়ারিতে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম, বুঝলেন? জাস্ট হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম! বইয়ের কন্টেন্ট অসাধারণ, তা বলে এতদিন ধরে ঢিকিশ ঢিকিশ করে শোনা পোষায় নাকি?! শেষের দিকে Marty-র শান্ত, মসৃণ গলাটা শুনলেই ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলতে ইচ্ছে করত। কান বলত ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি! মন নং ১ বলত “শুরু যখন করেছিস, শেষ করবি না পাগলী? প্লিজ, আর ইকটু, আর জাস্ট কয়েকটা দিন!” মন নং ২ পার্কের মধ্যেই হাত-পা ছড়িয়ে বসে পড়ত, অন্য কিছু শুনতে চাইত, অন্য কিছু ভাবতে চাইত সে। তাকে তখন গান শুনতে দিতাম আমি। যেই গান তার পছন্দ….

যাহোক, ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে শুরু করলাম Vyasa: The Beginning, আর মাঝের দিকে Panchali: The Game of Dice। এই দুটো বই একটা ongoing গ্রাফিক নভেল সিরিজের অংশ, যার বিষয়বস্তু আমাদের আদি মহাকাব্য মহাভারত থেকে গৃহীত। লেখক শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়, অলঙ্করণে শঙ্খ ব্যানার্জি।

শঙ্খদাকে আমি অল্প অল্প ইকটু ইকটু চিনি। আর শঙ্খদার ইলাস্ট্রেশন করা বইপত্তর ঠকাস করে কিনেও ফেলি। কিনে আলমারিতে ভরে রাখি। কেন? কারণ ভাল জিনিস ভাল করে পড়তে হয়, এবং জলদি কা কাম শয়তান কা হোতা হ্যায়। শয়তানকে প্রশ্রয় না দেওয়ার জেদে বছর-দু বছর-তিন বছর গড়িয়ে যায়, ভাল বইয়ে নিজেকে ডুবিয়ে দেওয়ার মত অখণ্ড অবসর আর বেরোয় না আমার। দশভূজ দুর্গাপদর বই কেনা অব্যাহত থাকে, ফ্রাস্ট্রেশনে বইয়ের দিকে, বইয়ের আলমারির দিকে ফিরে তাকাইনা আমি।

এইবার সেই প্যাটার্ন ব্রেক করলাম। আরে, আমার পরিচিতের করা একটা দারুন এক্সপেরিমেন্ট চারিদিকে শোরগোল ফেলছে, আর সেই কাজের স্বাদগ্রহণ করা হচ্ছেনা আমার — এটা কি একটা গর্বের কথা, বলুন? তারপর আছে সাবজেক্টের আকর্ষণ। না, আমি মিথলজি, হিস্ট্রি, আর্ট, লিটারেচার কিছু নিয়েই চর্চা করিনি কোনদিন, কিন্তু পাঞ্চালি চরিত্র হিসেবে আমায় ভাবায়। ইন ফ্যাক্ট, ২০২০র লকডাউনের সেই ভীষণ ভয়-ভয় সময়ে, গৃহবন্দী অবস্থায়, সেকেন্ড প্রেগন্যান্সি সামলাতে সামলাতে চিত্রা ব্যানার্জি দিভাকারুনির ‘The Palace of Illusions’ পড়ার পর থেকে পাঞ্চালি আমায় হণ্ট করে। অতএব Vyasa আর Panchali আমায় পড়তেই হল।

কখন পড়লাম? কিভাবে পড়লাম? ছানারা সব রাতে ঘুমিয়ে পড়ার পর তাদের পাশেই শুয়ে শুয়ে হ্যান্ডহেল্ড ইমারজেন্সি ল্যাম্পের আলোয় পড়লাম। এরপর সারা রাত হয়তো আর ঘুম হবেনা, ছোটটা হয়তো নড়াচড়া শুরু করবে একটু পরেই, ইনসমনিয়া আরো worsen করবে, আর ভোর ৬:৩০ তে উঠে বড়টাকে স্কুলের জন্যে তৈরি করতে হবে, এসব জেনেও পড়লাম। পড়তে যখন খুব ভাল লাগছে, মুড তৈরি হচ্ছে জব্বর, একটা ফাঁকা ঘরে গিয়ে আরাম করে বসে গোটা রাত্তির ধরে পড়ে বই শেষ করে ফেলতে ইচ্ছে করছে, তখন নিজের রাশ টানলাম। পড়ার বদলে যখন ঘন্টাখানেক ধরে শুধু পাতাজোড়া দারুন, দারুন, দারুন ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে, তখন নিজেকে সেটাই করতে দিলাম। অনেকগুলো রাত চলল এরকম, জানেন তো, অনেকগুলো — বেশ কটা সপ্তাহ। আমি এমনিতেই শ্লথগতির মানুষ, তারওপর এরা বড় সেরিব্রাল কাজ। বলিষ্ঠও নিঃসন্দেহে। আমাদের সামাজিক বিবর্তনের ইতিহাস বহন করতে চায় যে কাজ, আমাদের ভাবাতে চায় মিথ ও আজকের পৃথিবীর নৈকট্য নিয়ে, চটপটে মশলামুড়ি হওয়া তো তার সাজে না। দমপখত গোস্ত হতেই হয়। ধুমধাড়াক্কা পড়ে ফেললে ঠিক যেন জাস্টিস হয়না এদের সাথে।

যাহোক, শেষমেষ একদিন তারা শেষ হলেন। আর আমি মনে মনে নিজেকে এই এত্ত হাগ দিলাম, একটু একটু নেচে নিলাম।

আচ্ছা, ইচ্ছে থাকলেই কি উপায় হয়? দিনে থাকে তো সেই চব্বিশটা ঘণ্টা। আপনারই সব ইচ্ছেরা যদি অসভ্যের মতন একে অপরের গলা টিপে সেই চব্বিশ ঘণ্টার দখল নিতে চায়, তাহলে কি করা যায়? যদি সিক্স-প্যাকধারী পাড়ার দাদা গোছের ইচ্ছেগুলো নরম নরম আলোর মতন ইচ্ছেগুলোকে পাঞ্জার লড়াইয়ে হারিয়ে দ্যায় রোজ রোজ? অথবা যদি দিনজোড়া ব্যস্ততার মাঝে পনেরো-কুড়ি মিনিটের বাঁধা সময়ে ওদেরকে কেটেছেঁটে জোর করে আঁটাতে খুব কষ্ট হয় আপনার? যদি কিছু বেয়াড়া, ওদিকে হেতুবিহিন ইচ্ছে রুটিনের তোয়াক্কা না করে বেপরোয়া মাঠ, নদী স্রোত, গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে চলকে পড়া সূর্য দাবী করে? কি করা যায় বলুন, কি করা যায় তাহলে?

তখন ডুবতে দিতে হয় বুঝি, নরমদের? ভবিষ্যত, সংসার, বা বাস্তবের দোহাই দিয়ে ভুলে যেতে হয় বুঝি, খুব স্মিত আলোদের? নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে মরতে দিতে হয় বুঝি, সেই নিজেকেই?

দিয়েছি তো, আমিই তো দিয়েছি কত কত বার। তারপর আয়না যখন অচেনা হয়েছে, খুব অন্ধকারে আকাশের দিকে তাকিয়ে ধ্রুবতারাকে যখন খুঁজে পাইনি আর, তখন আবার খুঁজতে বেড়িয়েছি নিজেকে। যাকে হেলায় হারিয়ে যেতে দেওয়া হয়, তার মান ভাঙ্গানো কি সহজ?

আজকাল খুব চেষ্টা করি নিজের সবটাকে বাঁচিয়ে রাখতে, ভাসিয়ে রাখতে। পাড়ার দাদা ইচ্ছেগুলো বাকিদের বেশী চাপতে গেলেই চোয়ালে ঘুঁষি মেরে দি কষিয়ে। অনভ্যাসের অবাক চোখে তাকায় তারা। মস্তিষ্ক আর মন চোখ চাওয়াচাওয়ি করে, কে যে কি বোঝে ঈশ্বরই জানেন!

আসলে, অনেকটা মমতা আর কিছুটা স্বার্থপরতা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হয় এক-একটা স্বপ্নের বীজকে, হয়তো বা বছরের পর বছর। চারাগাছের দাবী অনেক। বীজের দাবী কম — “আমায় ফেলে দিওনা”। উপযুক্ত মাটি, জল, হাওয়া, রোদ্দুর কবে আসবে তা কে বলতে পারে? বীজ বলে — “অপেক্ষা কর। নিজেকে প্রিজার্ভ করতে শেখ। হারিয়ে যেওনা।”

Vyasa আর Panchali বুঝি এরকমই সন্তর্পনে বাঁচিয়ে রাখা স্বপ্নবীজের চারা। তাই বুঝি অগাধ যত্ন, অকৃপণ পরিশ্রমে তৈরি করা এদের প্রত্যেকটা পাতা।

পড়ে দেখতে পারেন। ইন ফ্যাক্ট, হাইলি রেকমেন্ডেড।

- অন্তরা (13-Apr-2023)

Empowered: Ordinary People, Extraordinary Products — https://amzn.eu/d/ja6sbl8

Vyasa: The Beginning — https://amzn.eu/d/95tv0hl

Panchali: The Game of Dice — https://amzn.eu/d/6RZRWnN

--

--