গোগ্রাসী-বিড়ম্বিত-আমি (বিরিয়ানি পর্ব)

Antara Kundu
4 min readAug 10, 2021

--

Source, no copyright infringement is intended

তখন লিলুয়াতে একটি প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ি। বাড়ী ব্যারাকপুর। ব্যারাকপুর স্টেশন থেকে রোজ অটো ধরে টিটাগড় যাই, সেখান থেকে ৫৬ নম্বর বাস ধরে লিলুয়া। তখনও নিবেদিতা সেতু হয়নি। টিটাগড় থেকে বিটি রোড ধরে ডানলপ হয়ে দক্ষিণেশ্বর হয়ে বালি ব্রিজ পেরিয়ে বিতিকিচ্ছিরি জ্যাম আর হাসফাঁসে ঘেমো গরমে আধসেদ্ধ অবস্থায় কলেজে পদার্পণ। সন্ধ্যেবেলা ফেরার সময়ও একই গল্প।

তা ফেরার সময়ে মাঝেমধ্যে পা ফসকাতো। এই ধরুন, ব্যারাকপুর স্টেশনের বাইরেই যে সারি সারি রোল-চাউমিন-মোগলাই-এর দোকানগুলো আছে, পা ফসকে গিয়ে পড়তাম তার একটার সামনে। কখনো আবার ডানদিকের লস্যির দোকানগুলোর দিকে চলে যেত পা দুটো, আপনা-আপনিই, বিশ্বাস করুন! আর সেদিন তো হড়কে 'সোনা' রেস্তোরাঁর ভেতরেই চলে গেল তারা! কি কারণে যেন তাড়াতাড়ি ছুটি হয়েছিলো। দুপুর আর বিকেলের মাঝামাঝি একটা সময়ে ব্যারাকপুর স্টেশন পৌঁছেছি। 'সোনা'-র বিশাল বিরিয়ানির হাঁড়িদুটো তখন রাখা থাকতো রেস্তোরাঁর বাইরে, ঠিক ঢোকার মুখটিতে। ওখান থেকেই প্লেটে প্লেটে, বাক্সে বাক্সে সাজিয়ে দেওয়া হতো বিরিয়ানি। একটা মন-ভালো-করে-দেওয়া সাইজের আলু, তার ওপর ইয়াব্বড় চিকেন বা মাটনের পিস, একটা সেদ্ধ ডিম, আর তার ডান-দিক-বাঁ-দিক-ওপর দিয়ে ছড়িয়ে ছড়িয়ে, মিশিয়ে মিশিয়ে দেওয়া বেশি মশলা আর কম মশলাওয়ালা রাইস। একটাই হাঁড়ির বিভিন্ন দিক বা লেয়ার থেকে কেটে তোলা হয় সেই রাইস। ওই আর্টওয়ার্ক আপনি-আমি পারবো না। আনাড়ি হাতে ছন্দপতন হবে।

পুরো স্টেশন চত্বর ম-ম করতো সুগন্ধে। সেদিনও করছিলো, কারণ দুপুর গড়িয়ে যাওয়া অবেলাতেও 'সোনা' তে কাস্টমারের ভীড় ছিল অব্যাহত। আমার পায়ের আর দোষ কি বলুন?

যাহোক, ভিতরে ঢুকে দেখি বসার জায়গা নেই। সব টেবিল ভর্তি। ওদিকে ঢোকার মুখে হাঁড়ির দৃশ্যে পেটের ছুঁচোরা সপরিবারে কুংফু শুরু করে দিয়েছে। রেস্তোরাঁর এক কোণে চুপটি করে দাঁড়িয়ে কম পাওয়ারের টিউবের আলোয় সব কটা টেবিল ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে যা বুঝলাম, এক-একটা টেবিলে যে এক-একটা গ্রুপ বা ফ্যামিলি বসেছে তা নয়। বস্তুতঃ যে যেখানে ফাঁকা পেয়েছে বসে পড়েছে। ৪ জনের টেবিলে অন্তত ৬-৭ জন করে মানুষ। অতএব আমি আর পিছিয়ে থাকি কেন? এক কাকীমাকে সবিনয়ে সরে বসতে বলে বসে পড়লাম তার পাশটিতে। "একটা মাটন বিরিয়ানি দেবেন দাদা, রেওয়াজী পিস।"

'দাদা বৌদি', 'সোনা' - ব্যারাকপুরের এই অতি জনপ্রিয় বিরিয়ানির রেস্তোরাঁগুলো এখনও আধুনিক রেস্তোরাঁ ব্যবসার হিসেবনিকেশ সব উল্টে দিতে পারে। এখানে 'অ্যামবিয়েন্স' তৈরি করে বিরিয়ানির ভুরভুরে সুগন্ধ আর আপনার চোখের সামনে রাখা পেল্লায় হাঁড়ি, আর কিচ্ছুটি দরকার হয়না। স্টাফ কার্টসির পরীক্ষা হয় "দাদা, একটা আলু এক্সট্রা দেবেন।" বা "ডিমটা বাদ দিয়ে তার জায়গায় একটা ছোট ফ্যাট পিস দিয়ে দেবেন মাটনের।" জাতীয় আবদার দিয়ে। আর স্টাফ যদি অর্ডার নেওয়ার সময় নিজে থেকে জানতে চায় মাটন না চিকেনের ঠিক কেমন পিস চাই আপনার, তাহলে জানবেন, ওই রেস্তোরাঁ মিশেলিন ফাইভ স্টারের ইকুইভ্যালেন্ট!

আর্টিস্টিক ওয়াল ডেকর, শৌখিন লাইটিং, ওয়েল-গ্রুমড স্টাফের সম্পূর্ণ নিকুচি করেও কতোটা কাস্টমার স্যাটিসফ্যাকশন এবং প্রফিটাবিলিটি তৈরি করা যায়, তা বোঝা যায় এই রেস্তোরাঁগুলোতে ঢুকলে।

মূল গল্পে ফিরি। মাটন বিরিয়ানির প্লেটটা সামনে আসার মুহুর্ত থেকে পরের আধ ঘণ্টা কিভাবে কেটেছিল মনে নেই। ওটা একটা মোহাচ্ছন্ন সময়, ওভাবে ডিটেলস দেওয়া যায় না। প্লেট ফাঁকা করে বিল মিটিয়ে যখন বেরোলাম, সন্ধ্যে তখনও হয়নি। উড়ু-উড়ু মন নিয়ে হেঁটে হেঁটে চৌদ্দ নম্বর রেলগেটের দিকে যাচ্ছি, রেলগেট পেরিয়ে আরো বেশ খানিকটা হেঁটে গেলে আমাদের বাড়ি। এমন সময় পেছন থেকে ডাক এলো "এই যে ম্যাডাম, একবার শুনবে?"

ঘুরে তাকিয়ে দেখি একটা তালঢ্যাঙা ছেলে, বয়সে আমার থেকে একটু বড়ই হবে, দাঁড়িয়ে আছে আমারই দিকে তাকিয়ে। জিন্দেগিতে দেখিনি আমি তাকে।

"সেই বিরিয়ানির দোকান থেকে ফলো করছি তোমাকে। হনহন করে হেঁটে চলেছো। ডাকলে শুনতে পাওনা?"

কেন? আমি কি বিল না মিটিয়ে চলে এসেছি? নাহ, স্পষ্ট মনে আছে পার্স খুলে টাকা বের করেছি, ম্যানেজারের হাতে দিয়েছি, দিয়ে এক গাদা মিষ্টি মৌরি কুরকুর করে চিবিয়ে খেয়েছি। কিছু ফেলে এলাম তালে? কি ফেলে এলাম?

"কি হলো? তুমি সোনায় বসে বিরিয়ানি খাচ্ছিলে তো? আমিও খেতে গিয়েছিলাম। ওখান থেকেই ফলো করছি।"

আচ্ছা, ছেলেটা কি এই রেলগেটের ধারে দাঁড়িয়ে প্রোপোজ করবে এবার? কেন করবে? ছেলেদের মতন এমন কার্যকারণ সম্পর্কবিহিন, কাণ্ডজ্ঞানবর্জিত প্রজাতি তৈরি করার প্রয়োজনটাই বা কি ছিল ভগবানের? বিড়ম্বিত হই যারপরনাই, একুশ বছরের লাজুক-শান্তশিষ্ট-গোগ্রাসী আমি। কি বলবো বুঝে উঠতে পারি না। আমি তো চোখ পাকাতেও শিখিনি।

সে আমার মুখ দেখে বোঝে। এবং অভয় দেয়।

"তুমি ভয় পেও না। আমি শুধু একটা কথা বলতে এসেছিলাম, বলে চলে যাবো। আর বিরক্ত করবো না।"

আমি অপেক্ষা করি। বিড়ম্বনা আঠার মত লেগেই থাকে সেই অপেক্ষার গায়ে। আর লেগে থাকে কিঞ্চিৎ কৌতূহল।

"তুমি একা একা রেস্তোরাঁয় ঢুকে বিরিয়ানি খাচ্ছিলে, আমার খুব ভালো লাগলো দেখে। আমি এর আগে কোনো মেয়েকে এভাবে একা রেস্তোরাঁয় খেতে দেখিনি। আমার তোমাকে কংগ্রাচুলেট করতে ইচ্ছে হলো, তাই ফলো করে এলাম। এবার আমি আসি।"

লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে যায় সে। হাসতে হাসতে যায় কি, আমার মুখের অবস্থা দেখে? কে জানে! মুখের দিকে আর তাকাতে পেরে উঠলাম কই, এই কথার পর?

আমিও চলে যাই, চৌদ্দ নম্বর রেলগেট পেরিয়ে, তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে, সাত-সমুদ্দুর-তেরো-নদীর ওপারে আমার একান্ত নিজের ঘরটিতে। আমার ঘরের বারান্দায় থাকে টবের সারি, আর টবে বোনা থাকে স্বপ্নবীজ।

আমি হাঁটি জোরকদমে, দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকে পায়ের বুড়ো আঙুলে, মুখ থাকে খুব গম্ভীর। বলা তো যায় না, যদি আবার তার ফলো করার ইচ্ছে হয়?

অথবা.... আমি আসলে হাঁটিই না। মাটি থেকে দু ইঞ্চি ওপরে পড়ে আমার পা, কেউ খেয়াল করে না। ঢোলা কামিজ ঢেকে রাখে আমার ছোট্ট দুটো ডানা কে, কেউ খেয়াল করে না। এবং আমি খুব হাসি, হাসতে হাসতে পেট ফেটে যায় আমার, ফেরার পথে। ভাগ্যিস.... এটাও কেউ খেয়াল করে না!

- অন্তরা, ১০ অগাষ্ট ২০২১

--

--

Antara Kundu
Antara Kundu

No responses yet