আমার সলিচুডের স্যালাডেরা
২০১৪-র ডিসেম্বর থেকে ২০১৫-র মার্চ, এই চারটে মাস বড্ড ভালো কাটিয়েছিলাম। লন্ডনের স্ট্র্যাটফোর্ডে একটি ছিমছাম, সুন্দর সার্ভিস অ্যাপার্টমেন্টে। একা। যারা জানেন, তারা জানেন, যে ‘একা’ মানেই নিঃসঙ্গ বিষন্নতা নয়। অনেকের কাছেই ‘একা’ মানে স্বাতন্ত্র্যের তুমুল উদযাপন।
গিয়েছিলাম অফিসের কাজে। কাজ করতাম ঘড়ি ধরে, আর শহরটার অলিতে গলিতে ঘুরে বুক ভরে হাজার বছরের অজানা ইতিহাসের ঘ্রাণ নিতাম এক্কেবারে ঘড়ি না ধরে। লন্ডন এবং লন্ডনের আউটস্কার্টস জুড়ে ছড়ানো রাশি রাশি অতি বিখ্যাত ফোর্ট, প্যালেস, মিউজিয়াম এবং অন্যান্য মনুমেন্ট-এর কথা নাহয় ছেড়েই দিলাম। কিন্তু রাস্তার ধারে ধারে যে ছবির মতন লাল বা খয়েরী রঙা কটেজের সারি, টেমস নদীর পাড় জুড়ে যে ওল্ড স্টাইলের নানাবিধ গম্ভীরদর্শন বিল্ডিং, এরা ঠিক কবে তৈরি? কারা থেকেছে এসব বাড়িতে, হেঁটে গেছে এসব রাস্তা দিয়ে? আজন্ম দুর্ভাগা, ভালোবাসার কাঙাল কোনো অলিভার টুইস্ট? পারিবারিক আভিজাত্যের ভারে ক্লান্ত কোনো ষোড়শী, যার আলমারিতে থরে থরে সাজানো বল-গাউন, ফিনফিনে সাদা গ্লাভস আর এমন একটি হীরের নেকলেস, যার জন্য মানুষ খুন করা যায়? আর এমন অদ্ভুত সেই খুনের ধরণ, যার জন্য স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড কে মাথা নোয়াতে হয় শার্লক হোমসের কাছে?
অফিস, আর ছাড়া গরুর মতন চরে বেরিয়ে শহর দেখা, এই দুইয়ের ফাঁদে পড়ে রান্নার জন্য সময় থাকতো খুব কম। রান্নাটা আমি স্বদেশ এবং স্বগৃহেও বরাবরই আউটসোর্স করবার চেষ্টা করি। ওখানেও সপ্তাহে একদিন ১৫ পাউন্ড (তখনকার হিসেবে ১ ব্রিটিশ পাউন্ড প্রায় ৯৯ টাকা) খরচ করে কোনো শৌখিন ব্রিটিশ রেস্তোরাঁ থেকে ক্যাপুচিনো সহযোগে ‘ব্রিটিশ ফিশ অ্যান্ড চিপস’ না খেতে পারলে আমার পেটের ভাত হজম হতো না। কিন্তু সপ্তাহের বাকি দিনগুলো? লন্ডনে রেডি-টু-ইট মিলের জনপ্রিয়তা মারাত্মক। কিন্তু ৫ পাউন্ডের নীচের ডিসকাউন্টেড আইটেম গুলোর স্বাদও কেমন যেন ডিসকাউন্টেড হত। চার মাস ধরে ওই খেয়ে আমি যদি উল্টে পড়ি, হোথায় আমারে দেখবে কে? আর ‘পার ডিয়েম’-এর টাকায় অত অ্যাফোর্ড-ই বা করা যায় কদ্দিন?
অতএব মার্লিন অ্যাপার্টমেন্টের ভারী সুন্দর কিচেনটিতে দিনে ২০ থেকে ৩০ মিনিট আমাকে ব্যায় করতেই হতো। কি রান্না করতাম? ভাত। সঙ্গে সেইন্সবারি’জ থেকে কিনে আনা ঠিক ৮টি মুরগির ঠ্যাং, যাতে করে পরের চারটি মীলে ২টি করে ঠ্যাং জোটে। একদম বাঙালি স্টাইলে পেঁয়াজ-রসুন-আদা-জীরের গুঁড়ো-গোটা গরম মশলা-ডুমো ডুমো আলু দিয়ে তৈরি হালকা মুরগির, থুড়ি, মুরগির ঠ্যাং-এর ঝোল। কখনোসখনো পনীর পেলে ৪০০ গ্রাম পনীর বানাতাম, আর মাঝেমধ্যে স্বাদ বদলের জন্য ৪টি ডিম দিয়ে মাখামাখা কারী। দুদিনের মাপের। ব্যাস, কার্বোহাইড্রেট এবং প্রোটিনের রিকুয়ার্মেন্ট ফুলফিলড!
চিন্তায় পড়েছিলাম সবজির ইনটেক নিয়ে। ৪ মাস সবজি না খেয়ে থাকা তো ভালো ব্যাপার নয়, আর ওখানকার বাজারে এত ফ্রেশ ফল আর সবজির সমাহার যে দেখলেই ব্যাগ ভর্তি করে কিনে নিতে ইচ্ছে করে। রান্নায় চরম ফাঁকিবাজি করেও রেগুলার সবজি খাওয়ার দুটো সহজ উপায় আছে — ভাতে সেদ্ধ দিয়ে দিন, নয়তো প্রেসার কুকারে ডাল বানিয়ে নিন হরেকরকম সবজি দিয়ে। ওখানে হাঁড়ি আর প্রেসার কুকার, কোনোটাই ছিল না। ভাত রান্না আর ফ্যান গালার জন্য যে সার্কাসটা করতাম তার বিবরণ অন্য কোনো দিন দেবো, কিন্তু ওর মধ্যে গাজর, বেগুন, কুমড়ো সেদ্ধ দিলে ব্যাপারটাকে কোনক্রমেই দাঁড় করানো যেত না। তবে উপায় কি? উপায় হলো স্যালাড!
আজ্ঞে না, খেতে বসার ঠিক দু মিনিট আগে ঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচ করে চাট্টি শশা-পেঁয়াজ কেটে নেওয়ার কথা বলছি না আমি। এই স্যালাড হচ্ছে ‘টস্ড স্যালাড’ (tossed salad), অর্থাৎ সামান্য তেল বা তৈলাক্ত কোনো ড্রেসিং-এ সবজি ‘টস’ করে তৈরি স্যালাড। সবজি বোলে তো কেয়া সবজি? সে মশাই আপনার যা ভালো লাগে কিনুন না! ওই ট্রিপেই ক্লায়েন্ট অফিসের দুর্ধর্ষ ক্যান্টিনটিতে সদ্য তৈরি পট্যাটো-অলিভ স্যালাড আর বিটরুট স্যালাড খেয়ে মুগ্ধ হয়েছি আমি। ২০১২-র কেরালা ট্রিপে মুন্নারের রিসর্টে খেয়েছি কমলালেবুর রসে ভেজানো আনারসের অতি সুস্বাদু স্যালাড। আজকাল অনেক চাইনিজ রেস্টুরেন্টে মেইন ডিশের সাথে কিমচি (kimchi) স্যালাড দ্যায় দেখবেন; কিমচি হলো বাঁধাকপি আর পেঁয়াজের স্যালাড। কিছু ইউরোপিয়ান ডিশের সাথে পরিবেশিত হয়ে থাকে কোলস্ল (coleslaw) — সেও আরেক ধরনের বাঁধাকপির স্যালাড, মেয়নিজ (mayonnaise) বা ভিনাগ্রেট (vinaigrette) ড্রেসিং-এর সাথে; আমার ভারী প্রিয়। ব্যাঙ্গালোর-এর অফিস ক্যান্টিনে বহুবার খেয়েছি নারকেল কুচি আর ‘এটা-সেটা-মিক্স’ দিয়ে অঙ্কুরিত মুগডালের স্যালাড। এর প্রত্যেকটিই কিন্তু নিজস্ব স্বাদ ও গুণে ভাস্বর।
এবার আমি ধরুন আপনাকে বললাম — “মশাই, আর যাই করুন, স্যালাডে কুমড়ো, বরবটি, উচ্ছে, বেগুন, পুঁই শাক দেবেন না প্লীজ”। আর তারপরই ধরুন ‘মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়া’-র কোনো এক এপিসোডে কোনো এক ঊর্বরমস্তিষ্ক শেফ ঠিক এই জিনিসগুলো দিয়েই চমৎকার স্যালাড বানিয়ে তাক লাগিয়ে দিল সবাইকে, তখন আপনি আমাকে ছেড়ে কথা বলবেন?
তার চেয়ে বরং আমি আপনাকে বলি, আমি এখনো পর্যন্ত কি কি উপাদান দিয়ে স্যালাড বানিয়েছি। একবার উঁকি মেরে দেখে নিন সঙ্গের ছবিগুলিকে। ওখানে কিন্তু দুটি আলাদা স্যালাডের ছবি আছে।
১. একটি স্যালাডের প্রধান উপকরণ আলু, বিন্স, গাজর, মটরশুঁটি, সবুজ ক্যাপসিকাম, চেরী টমেটো ও ডিম। যতদূর মনে পড়ছে, আলু, বিন্স ও গাজর সামান্য সেদ্ধ করে নিয়েছিলাম আগে। তারপর প্যানে অল্প অলিভ অয়েল দিয়ে ওগুলো আর বাকি সবজি (টম্যাটো বাদে) এক সাথে মিশিয়ে নাড়াচাড়া করেছি। টম্যাটো অ্যাড করেছি সবার শেষে, যাতে গলে না যায়। ক্রাঞ্চ আনার জন্য ব্যাবহার করেছি রোস্টেড আমন্ড ও ওয়ালনাট। ওপরে সাজিয়ে দিয়েছি ডিম সেদ্ধ। গিল্টকে গলাধঃকরণ করে ড্রেসিং হিসেবে ব্যবহার করেছি মেয়নিজ। আর কিছু ব্যবহার করেছিলাম কি? উমমম… ভুলে গিয়েছি। ছবিটি ২০১৫-র।
২. পরের স্যালাডটি ব্যাঙ্গালোরে বানানো। ২০২০-তে। অতিমারীর প্রথম ঢেউয়ের আবহে। প্রধান উপকরণ ফারফালে (farfalle) পাস্তা, বেবী স্পিনাচ বা কচি পালং পাতা, লাল ও হলুদ ক্যাপসিকাম, চেরী টম্যাটো এবং ডিম। বড় পাত্রে ফুটন্ত জলে সামান্য নুন আর এক-দু ফোঁটা তেল দিয়ে পাস্তা সেদ্ধ (al dente) করে জল ফেলে দিয়েছি। তারপর ঠান্ডা জলে সেই পাস্তা ধুয়ে জল ঝরিয়ে রেখে দিয়েছি খানিকক্ষণ। আরো পরে প্যানে অলিভ অয়েল আর পাস্তা দিয়ে সামান্য নাড়াচাড়া করে তুলে রেখেছি। পালংটাও আলাদা করে ধুয়ে জল ঝরিয়ে অলিভ অয়েলে অল্প নাড়াচাড়া করে তুলে রেখেছি। নেক্সট স্টেপ, প্যানে ফ্রেশ অলিভ অয়েল নিয়ে তার মধ্যে কয়েকটা কুচোনো রসুন দিয়ে নাড়াচাড়া করা, যতক্ষণ না রসুনের সুগন্ধ বেশ সুন্দরভাবে বেরোচ্ছে। এবার তার ওপর পড়ছে পেঁয়াজ আর রেড, ইয়েলো ক্যাপসিকাম। একদম শেষের দিকে পড়ছে চেরী টম্যাটো। অবশেষে কাঁচের পাত্রে পাস্তা, পালং আর বাকি উপাদান এক সাথে মিশিয়ে ওপর দিয়ে ডিম সেদ্ধ সাজিয়ে পরিবেশন করা হয়েছে। এক্সট্রা ফ্লেভার আনার জন্য ব্যবহার করেছি পাতিলেবুর রস আর অরিগ্যানো সিজনিং ।
ওহ, বলা হয়নি, আমি স্যালাড বানালে নুন দি সবার শেষে। আগে দিয়ে দেখেছি, সবজিগুলো থেকে জল বেরিয়ে মিইয়ে যায় কেমন, ব্যাপারটা আর স্যালাড থাকে না, বিচ্ছিরিমতন না-ঘর-কা-না-ঘাট-কা তরকারি হয়ে যায় প্রায়। এলিমেন্টগুলোর অরিজিনাল রং-শেপ বজায় না থাকলে, আর বেশ একটা ক্রাঞ্চ না থাকলে স্যালাড হয় নাকি?
আরও বলে রাখি, স্যালাডে অনেক ধরনের ড্রেসিং ও সিজনিং ব্যবহার করা যায়। আজকাল এই ধরনের রেডিমেড ড্রেসিং সুপারমার্কেটগুলিতে পাওয়া যায়। আবার বাড়িতে বানিয়ে নেওয়ার রেসিপিও ইন্টারনেটে সহজলভ্য। যেহেতু আমি মানুষটা আদ্যন্ত ফাঁকিবাজ, আমার কাছে এসব কিছুই থাকে না। লন্ডনে তো আরোই থাকতো না। আমি তাহলে বৈচিত্র্য আনতাম কি দিয়ে? মূলতঃ নানাধরনের উপাদান ও তাদের কম্বিনেশন দিয়ে, আর ফ্লেবার নিয়ে টুকটাক এক্সপেরিমেন্ট করে। বেবী কর্ন, সুইট কর্ন, ব্রোকলি (broccoli), ব্রাসেলস স্প্রাউট (Brussels sprouts) আর লেটুস (lettuce) ব্যবহার করেছি মাঝেসাঝেই। পনীর বা চিকেন সসেজ ছোট ছোট করে পিস করে ভেজে দিয়ে দিয়েছি। পেঁয়াজ, রসুন কুচি, আদা কুচি ছাড়াও ফ্লেভর এসেছে গ্রেটেড চিজ, গোলমরিচ, লেবুর রস, বা পিৎজার দোকান থেকে বেঁচে যাওয়া অরিগ্যানো সিজনিং থেকে। একবার গোটা জীরে দিয়েও দেখেছিলাম, ঠিক দাঁড় করাতে পারিনি। আপনি পারতেই পারেন, এক্সপেরিমেন্ট করতে ক্ষতি কি?
লন্ডনের ওই চার মাসে যেমন এক দিন অন্তর অন্তর প্রোটিন ডিশ বানাতাম, তেমনি এক দিন ছেড়ে ছেড়ে স্যালাড-ও বানিয়েছি আমি। অর্থাৎ চার মাসে ষাট, আচ্ছা ষাট না হলেও ধরে নিন অন্তত পঁয়তাল্লিশ বার স্যালাড বানিয়েছি। আর যেদিন স্যালাড বানাতাম, সাথে ভাত-তাত কিছু আর বানাতাম না। আগের দিনের রান্না করা দু পিস ঠ্যাং ফ্রিজ থেকে বের করে মাইক্রোওয়েভে গরম করে এক বোল স্যালাড দিয়ে চমৎকার ডিনার হয়ে যেত। যতটা শর্টে মারা যায় আর কি। মনটা আসলে পরে থাকত বিরাট বাথটবটার দিকে। ও জিনিস তো দেশে ফিরে গিয়ে পাবো না। অতএব রান্না আর খাওয়ার মাঝে রোজ পাক্কা একটি ঘণ্টা ওই বাথটাবে মড়ার মতো পড়ে থাকাটা প্রায়োরিটি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। উষ্ণ গরম জলে মিশতো খাস ‘রোমান বাথ’ থেকে কেনা ল্যাভেন্ডার বাথ সল্ট। টাবের পাশে ডাইনিং সেট থেকে একটা চেয়ার এনে রেখে দিতাম জাস্ট মোবাইলটা রাখবার জন্য। মোবাইলে খোলা থাকতো ইউটিউব। ওই একটি ঘণ্টা স্ট্র্যাটফোর্ডের মার্লিন অ্যাপার্টমেন্টের বাথরুম ভেসে যেত “আমার দক্ষিণ খোলা জানালায়” বা “ক্যাফে ক্যাফে, আমার প্রিয়া ক্যাফে”-র সুরে। ওই যে, বললাম না, স্বাতন্ত্র্যের তুমুল উদযাপন? দৈনিক এই একটি ঘণ্টার জন্য পঞ্চব্যঞ্জনসমৃদ্ধ ডিনারের সাথে আজও হাজারবার কম্প্রোমাইজ করতে পারি আমি।
অফিসফেরতা প্রায়ই ঢুঁ মারতাম চকোলেটের দোকানগুলোতে। সমস্ত নামী, কম নামী, অনামী ব্র্যান্ডের চকোলেট-ই গান্ডেপিন্ডে গিলতাম। অ্যাসরটেড চকোলেটের বক্স কিনে নিয়ে যেতাম বাড়িতে। তা সত্ত্বেও ট্রিপের শেষে গোলাকার জালা গোছের কিছু হয়ে দেশে ফিরিনি। উল্টে ৫ কিলো ওয়েট ঝরিয়ে ফিরেছি। কিসের গুণে? স্যালাড!
অতএব করে দেখতে পারেন আপনিও, স্যালাডের সাথে গোগ্রাসী প্রেম! অভিজ্ঞতা জানান। টিপস দিন। হাতেকলমে ফাঁকিবাজি শিখুন ও শেখান।
আমি কিন্তু অপেক্ষায় রইলাম।
- অন্তরা, ৮ জুলাই ২০২১