অথ গার্ডেনিং গাথা (শেষ পর্ব)
পয়লা নভেম্বর সকালের কথা। মা উচ্ছে কাটতে বসে বেশ কটা লাল টুকটুকে উচ্ছের বীজ পেয়ে ধরিয়ে দিলো হাতে — “তোর নাইন ও’ ক্লক-এর চারা কবে বেরোবে তার ঠিক নেই, আপাতত এগুলো বুনে রাখ। জল পেলে দুদিনে গাছ বেরিয়ে যাবে।” হাবভাব দেখে বুঝলাম, মা আমার প্রোজেক্ট পোরটুলাকা (পোরটুলাকা = নাইন ও’ ক্লক) কে অলরেডি ফেইলিওর ধরে নিয়েছে, এই উচ্ছের বীজ নেহাতি সান্ত্বনা পুরষ্কার।
মায়ের দোষ নেই। পোরটুলাকার বীজ বুনেছিলাম সপ্তমীর দিন, অর্থাৎ তেইশে অক্টোবর। গত ৯ দিনে জারমিনেশনের সামান্যতম ইঙ্গিতও পাওয়া যায়নি। প্রতিদিন মাপা সূর্যের আলোয় মাপা জল দিয়ে মেইনটেন করে চলেছি মাটি, অথচ কোন রেসপন্স নেই। এটাই স্বাভাবিক কিনা তাও জানিনা, কারণ ‘আরবান টেরা’ বলছে সিড জারমিনেশনের জন্য দু সপ্তাহ অব্দি অপেক্ষা করতে হতে পারে। ফোনে ছোটমামার গলা শুনে মনে হয় ঠিক যেন কনভিন্সড নয় এই ব্যাপারে — “একটু অঙ্কুর তো বেরোনো উচিত ছিল রে এতদিনে, তুই কি আঙ্গুল দিয়ে হাল্কা করে মাটি সরিয়ে দেখবি?”
এর মধ্যে একদিন পায়রা এসে উলটে দিয়েছে দুটো পট। ছড়িয়ে যাওয়া মাটি পটে ঢুকিয়ে রেখেছি আবার, কিন্তু ওই মাটিতে পোরটুলাকার পোস্তদানার সাইজের বীজ আদৌ আর আছে কিনা বলা কঠিন। উচ্ছের বীজগুলো অন্যমনস্কভাবে অর্ধেক বুনে ফেলে রাখলাম ওই পট দুটোতেই। দুপুরের মধ্যে দেখি পিঁপড়ের লাইন লেগে গেছে উচ্ছে বীজের লোভে। অতএব আরেকটু হাত লাগাতে হল, বীজগুলো মাটির আরও নীচে চালান করলাম, জল দিয়ে রাখলাম বেশ খানিকটা করে।
কেটে গেল আরও ৩-৪ টে দিন। অবস্থার কোন পরিবর্তন নেই। পোরটুলাকার দেখাদেখি উচ্ছে বীজগুলো-ও ঘুমিয়ে পড়ল যেন। পিকুর গাছে জল দেওয়ার উৎসাহ অন্তর্হিতপ্রায়, আমিও মুষড়েই পড়েছি বলা যায়। শামুকতলায় ফোন গেল আবার, আর শামুকতলা থেকে এবার ফোন গেল শিলিগুড়িতে, আমার রসায়নশাশ্ত্রবিশারদ বোনের কাছে। বোনটি হাজার দৈনন্দিন ব্যাস্ততার মধ্যেও দিব্যি সুন্দর একটি বারান্দা-বাগান করেছে তার ফ্ল্যাটে, আর তার বাবা, অর্থাৎ আমার সেজমামার আলিপুরদুয়ারের বাড়ির ছাদ-বাগানের ফুলের সৌন্দর্য দেখার মতন। সাজেশন এলো, ট্রান্সপারেন্ট প্লাস্টিক কিংবা খবরের কাগজ দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে মাটি। শরতের ব্যাঙ্গালোরের ঠাণ্ডা ওয়েদার জারমিনেশন কে ব্যাহত করছে। মাটি ঢেকে রাখলে উষ্ণতা তৈরি হবে, অঙ্কুর দেখা যাবে দুদিনের মধ্যে।
ঢাকলাম মাটি। দুদিনের মাথায় আমার সমস্ত পট আলো করে যাদের আবির্ভাব ঘটল তারা অঙ্কুর নয়, শাদা তুলোর মতন ফাঙ্গাস। খবরের কাগজ দিলাম ফেলে, গনগনে রোদের মধ্যে বসিয়ে রাখলাম সবকটা পট। বোন বলল, “খবরের কাগজগুলো দিয়ে এমন ভাবে ঢাকতে হত যাতে মাটি আর কাগজের মধ্যে একটু গ্যাপ থাকে। মাটির গায়ে কাগজ লেগে থাকলে ফাঙ্গাস হবেই।” সত্য বচন, আমি পটে উঁচু করে মাটি দিয়েছিলাম, গ্যাপ মেইনটেন করার স্কোপ ছিল না। অতঃ কিম? প্রোজেক্ট কি তাহলে ডিসমিসড, অন্তত এবারের মত?
ছোটমামা বলল — “দ্যাখ, অনেক হয়েছে, এবার তোর পটের ম্যানুয়াল আলট্রাসোনোগ্রাফি দরকার। বীজগুলো কি অবস্থায় আছে, অঙ্কুর বেরিয়েছে না বেরয়নি না বেরিয়ে মরে গেছে, জানা দরকার তো!” দুটো পটের মাটি আঙ্গুল দিয়ে ঘেঁটে ফেললাম নির্মম ভাবে, তবু কনক্লিউশনে আস্তে পারলাম না। মাটিতে শাদা শাদা সুতোর মতন একটা-দুটো কি দেখলাম বটে, কিন্তু সেগুলো শুকিয়ে যাওয়া অঙ্কুর নাকি কমপোস্ট-এর অংশ তাও বুঝলাম না। ফোনে ফোনে চলতে থাকল আমাদের ‘রুট কজ অ্যানালিসিস’।
বীজগুলো কি খারাপ ছিল? মনে পড়ল, অর্ডার প্লেস করার আগে বীজের রিভিউ-রেটিং কিছুই দেখিনি। বিগবাস্কেটে পোরটুলাকার বীজ পাওয়া যায়, এতেই এত অবাক আর খুশি হয়েছিলাম যে আর কিছু চেক করার থাকতে পারে সেটা মাথাতেও আসেনি। এবার দেখলাম, ‘আরবান টেরা’-র বীজের রেটিং অত্যন্ত খারাপ। জারমিনেশন রেট নিয়ে সব কাস্টমারেরই বিস্তর অভিযোগ।
ছোটমামার সাথে আলোচনায় দ্বিতীয় জোরালো পয়েন্ট যেটা উঠে এলো সেটা হচ্ছে, আমি সদ্যজাত শিশুকে মাটন বিরিয়ানি খাইয়ে ফেলেছি। বীজ জারমিনেশনের জন্য সবথেকে ভালো সাধারণ মাটি। ‘অরগানিক কমপোস্ট’-এ জল পড়লে একটা ঝাঁঝালো গ্যাসের সৃষ্টি হয়। বীজ বা কচি অঙ্কুর সেই গ্যাস সহ্য করতে পারে না, শুকিয়ে মরে যায়। আমার তৈরি মাটিতে ‘অরগানিক কমপোস্ট’ বেশ ভালো পরিমাণেই ছিল, সম্ভবত তারই ফলে উচ্ছে বীজগুলো-ও জারমিনেট করতে পারেনি।
আজকাল দেখি কিছুই সহজে হয়না। সব অঙ্কেই ভুল হয়ে যায়। ‘রাইট ফার্স্ট টাইম’-এর কোটা সেই স্কুলবেলায় ক্লাসের পরীক্ষায় টপ-স্কোরার হওয়ার ঘোড়দৌরেই শেষ করে ফেলেছি মনে হয়। অথচ কল্পনা ছোটে বহুদূর, আর সেই কল্পনা দিনে দিনেই বড্ড বেশী আশাবাদী হয়ে উঠছে যেন। ঠকছি, ঠেকছি, আবার নতুন করে গুছিয়ে নিচ্ছি ভাবনাচিন্তা। হেরেও হারটা স্বীকার উঠতে পারছি না। ঘুঁটি সাজাচ্ছি, ঘুঁটি সাজাচ্ছি আবারও।
বাবারও কল্পনা ছুটত সময়ের আগে। মনে আছে, ক্লাস টেনের পর স্কুল চেঞ্জ করব। যেসব স্কুল শর্টলিস্ট করেছি, তার মধ্যে একটা ক্যালকাটা গার্লস। তখনও ফর্ম ইস্যু করেনি স্কুলগুলো। কাট-অফ মার্কস কি থাকবে, অ্যাডমিশন টেস্টে কি হবে তার ঠিক নেই। ওদিকে বাবা অফিস থেকে বেরিয়ে স্কুল বিল্ডিং দেখে এসেছে। আর সেই বিল্ডিং-এর পেছনের কোন এক ঘোরানো সিঁড়ি (সম্ভবত এমারজেন্সি এক্সিট) দেখে বাবার টেনশন বেড়ে গেছে — ওই সিঁড়ি দিয়ে নাকি হুটোপুটি করে নামতে গেলে পড়ে যাবার সম্ভাবনা প্রবল। অর্থাৎ, বাবার কল্পনায় আমি অলরেডি ক্যালকাটা গার্লস-এর অ্যাডমিশন টেস্টে উৎরিয়ে, ক্লাস-টাস শুরু করে, স্কুল বিল্ডিং-এ এমারজেন্সি ফেস করে, তাড়াহুড়োয় ওই ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে, পড়ে গিয়ে হাত-পা ভেঙ্গে হসপিটালাইজড। বাবাকে প্রচুর প্যাঁক খেতে হত আমাকে ঘিরে এসব সুদূরপ্রসারী কল্পিত আশঙ্কার জন্য। ইদানীং ভাবি, আমার সুদূরপ্রসারী কল্পিত আশা আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে শেষমেশ?
৮-ই নভেম্বর, দুর্গাসপ্তমীর ষোল দিনের মাথায়, পিকু আর লাইফ পার্টনার কে নিয়ে নার্সারিতে গিয়ে ছটা ফুলগাছ আর একটা ছোট্ট ক্যাকটাস কিনে আনলাম। ফুলের ঠিকুজি-কুষ্ঠী জানার চেষ্টাও করলাম না, চেনা-অচেনা মিলে যেগুলো দেখতে ভালো লাগলো কিনে ফেললাম। পরে ছোটমামার কথামতন গুগল লেন্স ইউজ করে দেখলাম উজ্জ্বল কমলা আগুনের শিখার মতন ফুলটির নাম ‘রেড ফ্লেম সেলসিয়া’। যথাযোগ্য নামকরণ। মিষ্টি দেখতে ছোট ছোট শাদা-বেগুনি ও ঘন বেগুনি ফুলগুলি ‘ব্লু উইংস’ বা ‘উইশবোন’। এ ছাড়া আছে ঘন লাল ও দুধ-শাদা ‘ক্রিসান্থেমাম’ বা চন্দ্রমল্লিকা। আরও আছে একটা মিষ্টি হলুদ ‘মারিগোল্ড’, বাঙালিদের সবথেকে পরিচিত শীতকালের ফুল।
অ্যামাজনে খান দুয়েক বড় ‘হ্যাঙ্গিং পট’-এর সাথে একটা লাল পোরটুলাকার চারা অর্ডার করেছিলাম এর মধ্যে। সামান্য মাটি আর শিকর-এর সাথে একটা ন্যাড়া ডাল ডেলিভারড হয়েছিল দিন দুয়েকের মধ্যেই। সেই ডাল-ও বেঁচে গেছে, ছোট্ট ছোট্ট পাতা গজাচ্ছে রোজই। বাসন মাজার বেসিনের ড্রেনেজ পাইপের পাশে একটা নাম-না-জানা গাছ একা একা বড় হচ্ছিল। মা সেটাকে এনে বুনে দিয়েছিল অ্যালো ভেরার টবে। সেই গাছ লকলকিয়ে বেড়ে উঠেছে এখন, আর তাতে চারটে টম্যাটো ফুল ধরেছে এই সপ্তাহে। আর একটা মাঝারি সাইজের প্লাস্টিক-এর টবে পালং শাক বড় হচ্ছে, সেও মায়ের ইনিশিয়েটিভ। ফ্ল্যাটের বারান্দাটার চেহারাই বদলে গেছে গত কুড়ি দিনে। রঙের বৈচিত্র্য আর নানান আকৃতির সবুজেরা সকাল-বিকেল মন ভালো করে দেয়।
পিকু কিন্তু আর গাছে জল-টল দ্যায় না ইদানীং। ওর সযত্নে রঙ করা পটগুলো বিনা ব্যাবহারে পড়ে আছে দেখেই হয়ত দুঃখ পেয়ে রণে ভঙ্গ দিয়েছে বেচারা। পোরটুলাকা আর ক্যাকটাস দুটো আরেকটু বড় হলে কাটিং করে করে পটগুলোতে লাগাবো ভেবেছি। আপাতত আমাদের গার্ডেনিং-এর গাথার এখানেই শেষ। সব কিছুতে ‘রাইট ফার্স্ট টাইম’ নাই বা হল, কিছু পথ ভেবে রাখা গন্তব্যে নাই বা পৌঁছল, যত চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করব তার চেয়ে বেশী না হয় ছেড়েই দিলাম। জীবনে সৌন্দর্য থাক, আজীবন সেই সৌন্দর্য কে দেখার মত চোখ থাক, অকৃত্রিমতা থাক দিনযাপনের পরতে পরতে। আর কি কিছু সত্যি-ই দরকার হয়?
না বোধহয়…।
(অন্তরা, 28-Nov-2020)
পর্ব ১:
পর্ব ২:
পর্ব ৩: