অথ গার্ডেনিং গাথা (পর্ব ২)
ব্যাঙ্গালোরে আমাদের মতন ওয়ার্কিং কাপল-এর সংখ্যা প্রচুর, এবং তার মেজরিটি আইটি প্রোফেসনাল। লং ওয়ার্কিং আওয়ারস-এর সাথে সাথে ক্রমবর্ধমান ট্রাফিক-এর সৌজন্যে লং কমিউট টাইম যুক্ত হয়ে আমাদের অবস্থা টা দাঁড়িয়েছে সারাদিন রেসের মাঠে ছোটা ঘোড়ার মত। তার ওপর বাড়িতে স্কুল-গোইং বাচ্চা থাকলে তো কথাই নেই, উইক ডেজের সকালগুলো পলাশীর যুদ্ধপ্রান্তর। কাজেই রোজ সকালে বাজারের ব্যাগ হাতে টাটকা মাছ, সবজি, ফল কিনতে বেরোনো, আর বাড়ি ফিরে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে নিউজপেপার পড়া মোটামুটি স্বপ্নাতিত বিলাসিতার মধ্যেই ধরি আমরা। নিজে হাতে শাকের আঁটির ভিতরের পাতা বা মাছের কানকো পর্যবেক্ষণ করে, আম-টাম টিপেটুপে শুঁকে দেখে বাজার করার ব্যাপারটা যে জীবন থেকে একেবারেই বাদ পড়ে গেছে তা নয়, তবে সেটা তোলা থাকে শনিবার বা রবিবারের জন্য। বাকি দিনগুলির জন্য ভরসা বিভিন্ন অনলাইন গ্রসার। করোনাপ্রদত্ত গৃহবন্দিত্বের দৌলতে এই বছরে তাদের জনপ্রিয়তা আরও ঊর্ধ্বমুখী।
এই সেক্টরে কম্পিটিশন কিন্তু কম নয়। বড় প্লেয়ারদের মধ্যে মার্কেটে আছে ‘বিগবাস্কেট’, ‘অ্যামাজন’, ‘ডি-মার্ট’। এদের অনলাইন স্টোরে বাসমতী চাল থেকে গোবিন্দভোগ হয়ে দোসা রাইস, জিরের গুঁড়ো থেকে সাম্বার মশলা ও পোস্ত, কেক বানাবার ভ্যানিলা এসেন্স, লাল শাক, পালঙ শাক, মায় ছানা কাটার পাউডার পর্যন্ত মজুদ আপনার জন্য। নিত্য প্রয়োজনীয় দুধ, দই, আলু, পেঁয়াজের জন্য এদের ডেলি সাবস্ক্রিপশন-ও গ্রহণ করতে পারেন আপনি। প্রতিদিন সকাল ৮টার আগেই আপনার দরজার বাইরে ঝুলিয়ে রাখা ব্যাগে চলে আসবে সমস্ত প্রয়োজনীয় সামগ্রী। তারপর আছে ‘ফ্রেশ-টু-হোম’, যারা ফ্রেশ ফিশ অ্যান্ড লাইভ স্টক (চিকেন, মাটন ইত্যাদি) বেসড অনলাইন মার্কেট হিসেবে নিজেদের এসট্যাবলিশ করে এখন অন্যান্য গ্রসারি আইটেম-ও সরবরাহ করছে। ‘লিশাস’ অসাধারণ ফ্রেশ মাছ-মাংস ডেলিভার করছে অসাধারণ ভালো প্যাকেজিং-এ, এবং এদের অফারিং-এ ক্রমাগত যুক্ত হচ্ছে ‘পেরি পেরি চিকেন’, ‘পুরানি দিল্লি কি মাটন শিখ কাবাব’, ‘চিকেন ব্রেকফাস্ট সসেজ’, ‘বেঙ্গলি স্টাইল ফিশ ফিঙ্গার’ এর মত দেশী-বিদেশি রেডি-টু-কুক (নট রেডি-টু-ইট) আইটেম-এর নতুনত্ব। ‘সুইগি গো’ বা ‘ডানযো’ আবার নিজেরা কোন স্টক মেইনটেন করে না। আপনি বললে ওরা ২০ কিমি দূরের বিখ্যাত বাঙ্গালি মাছের দোকান থেকে ফ্রেশ্-অ্যারাইভড দেড় কিলোর ইলিশ বা চিতল আপনার বাড়ি বয়ে পৌঁছে দিয়ে যাবে, বা পাশের পাড়ার ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ, অবশ্যই পারিশ্রমিকের বিনিময়ে।
সেদিন তৃতীয়া। দুপুরের দিকে বসে বসে বিগবাস্কেটের কার্টে একটা একটা করে আইটেম অ্যাড করছি আমি। ফুলকপি, বীট, করলা, লাউ, বেগুন, বাচ্চাদের টুথপেস্ট, নুন, চিঁড়ে, শাদা সর্ষে, মুরগীর লিভার ইত্যাদি মিলে ৩১টা আইটেম হল। খুঁজছি, আর কি প্রয়োজন বাড়িতে। এমন সময়ে কি মনে করে সার্চ মারলাম ‘নাইন-ও-ক্লক’ দিয়ে। বিগবাস্কেট রেজাল্ট শো করল — ‘পোরটুলাকা/নাইন-ও-ক্লক ফ্লাওয়ার সিডস — ৩০ পিসেস — রুপিজ ৮৯’। ছবিতে একটা ছোট্ট বাদামী খাম, গায়ে লেখা ‘আরবান টেরা — গার্ডেনিং | ডেকর | গিফটিং — আই অ্যাম পোরটুলাকা’। গলা ছেড়ে গান গাইতে ইচ্ছে করছে তখন। সেই মার্চ থেকে সপ্তাহে অন্তত ২ থেকে ৪ বার অনলাইন গ্রসারদের বিজনেস দিয়ে চলেছি, ব্যাটারা ফুলের বীজ রাখে যানতি পারিনি মুই! এবার খুঁজলাম ‘ইনকা’। বিগবাস্কেট চিনতে পারল না। নো প্রবলেম, একটা পেয়েছি তাই বা কম কি! আমার ১০ পিস দইয়ের ভাঁড়ের জন্য ৩০ পিস পোরটুলাকা সিডস এমনিতেই মোর দ্যান সাফিশিয়েনট।
অর্ডার প্লেস করার জন্য চটপট আইটেমটা খুলে দেখি, ও বাবা, ‘স্পেসিফিকেশন’, ‘কেয়ার ইন্সট্রাকশন’-এর সাথে সাথে ‘হাউ টু ইউজ’ সেকশন মাত্র ৫ টা সহজ স্টেপে শিখিয়ে দিচ্ছে কি ভাবে এই বীজ থেকে গাছ করতে হয়!
- ‘আরবান টেরা পটিং মিক্স’-এর সাথে এক কাপ ‘আরবান টেরা অরগানিক কমপোস্ট’ মিশিয়ে মাটি তৈরি করা ‘হাইলি রেকমেনডেড’।
- স্যাপ্লিং জারমিনেট করার ১-২ সপ্তাহ পর সেগুলোকে আলাদা আলাদা টবে ট্রান্সফার করুন।
- তৃতীয় পয়েন্টে মাটিতে ‘ভারমিকমপোস্ট’ ব্যাবহার করতে বলা হয়েছে।
- নেক্সট পয়েন্ট, মাসে একবার করে মাটির ওপর ‘নিম মিক্স’ ছড়িয়ে দিন।
- ফাইনাল পয়েন্ট, গাছগুলি বাড়তে শুরু করলে রেগুলারলি সূর্যের আলোটা যেন পায় সেটা দেখুন, নিজের গাছ বড় হতে দেখার আনন্দ নিন, এবং ফুলগুলিকে সম্পদ মনে করুন।
সার্চ করে দেখলাম, ‘ভারমিকমপোস্ট’, ‘নিম মিক্স’ এসবই আরবান টেরার প্রোডাক্ট, এবং সব কটিই বিগবাস্কেটে অ্যাভেলেবল। অ্যাগ্রেসিভ ক্রস প্রোমোশন-এর পারফেক্ট উদাহরণ। আমাদের ফুলের বীজ যখন কিনছেনই আপনি, তখন আমাদের আরও ৪টি প্রোডাক্ট আপনাকেই বেচার চেষ্টা করে দেখি!
আবার আরেক দিক দিয়ে ভাবলে, এই ‘হাউ টু ইউজ’ সেকশনটি একটি ‘কাস্টমার ডিলাইটার’ ফিচার-ও বটে। এই ‘কাস্টমার ডিলাইটার’ ব্যাপারটি কি? ধরুন, আপনার কোম্পানি তিন মাসের মধ্যে বাজারে একটি নতুন এবং কমপ্লেক্স প্রোডাক্ট লঞ্চ করতে চাইছে।কমপ্লেক্স প্রোডাক্ট বলতে ধরুন, বিগবাস্কেট-এর গোটা প্লাটফর্মটিই একটি প্রোডাক্ট। একটি অনলাইন রেসিপি শেয়ারিং অ্যাপ, কিডস এডুকেশন অ্যাপ বা একটি ওয়েব-বেসড বিল্ডিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমও হতে পারে আপনার প্রোডাক্ট। ধরুন, প্রোডাক্টটিকে ঘিরে ওভারল একটি ভিশন আপনার কোম্পানির আছে, কিন্তু ডিজাইন, ডেভেলপমেন্ট, টেস্টিং, এই সব কিছুর জন্য প্রয়োজনীয় রিসোর্সিং, টাইম বা বাজেট এসটিমেশন, মায় মার্কেটিং পর্যন্ত ঠিকঠাক প্ল্যান করা সম্ভব নয় যতক্ষণ না আপনি আপনার প্রোডাক্টটির ইনিশিয়াল ফিচার সেট ডিসাইড করছেন। এবার ধরুন, আপনার মার্কেট রিসার্চ/সেলস টিম, ইউজার এক্সপিরিএন্স টিম এরা সবাই মিলে আপনার হাতে ধরিয়েছে ১৩০টি ফিচারের লিস্ট, এবং আপনি বেশ বুঝতে পারছেন যে এই এতগুলি ফিচার ইমপ্লিমেন্ট করতে গেলে আগামী তিন মাস কেন, তেরো মাসেও আপনার প্রোডাক্ট মার্কেটে পা রাখার জায়গায় পৌঁছবে না। অতএব আপনাকে প্রায়রিটি ফিচার বেছে নিতে হবে, এবং এই কাজে আপনাকে হেল্প করবে বিভিন্ন ফিচার প্রায়রিটাইজেশন মডেল। এরকমই একটি মডেল হল ‘ক্যানো মডেল’। ‘ক্যানো মডেল’ অনুযায়ী আপনি ৩টি ক্যাটেগরিতে ভাগ করে ফেলতে পারেন আপনার ফিচারগুলিকে -
১ ) মাস্ট-হ্যাভ বা বেসিক ফিচার — এরা না থাকলে আপনার প্রোডাক্টকে পাতে দেওয়ার যোগ্য ধরা যায় না। অনলাইন স্টোরের ক্ষেত্রে ভরসাযোগ্য সাপ্লাই চেন, স্টোরেজ স্পেস, ডেলিভারি মেকানিসম, ওয়েবসাইট উইথ অর্ডার প্লেসমেন্ট সিস্টেম, ইন্টিগ্রেটেড সিকিওর পেমেন্ট সিস্টেম ইত্যাদি মাস্ট-হ্যাভ।
২) পারফরম্যান্স ফিচার — এরা আপনার প্রোডাক্টের কাস্টমার স্যাটিস্ফেকশন-এর মাত্রা বাড়ায়। অনলাইন স্টোরের ক্ষেত্রে বিভিন্ন আইটেমের কন্টিনুয়াস অ্যাভেইলেবিলিটি বা ফাস্ট ডেলিভারি এই ক্যাটেগরিতে পড়বে।
৩) ডিলাইটার — এরা আপনার কাস্টমার-এর জন্য প্লেজেনট সারপ্রাইজ। এদের ঘিরে কাস্টমার-এর কোন এক্সপেকটেশন থাকে না, কিন্তু পেলে তারা বেশ খুশি-ই হয়। যেমন আমার মতন আনকোরা মালী অনলাইন স্টোরে বীজ খুঁজতে গিয়ে একই পেজে বীজ থেকে গাছ বানানোর সহজ স্টেপস পেয়ে গেলে খুশি হয়। বাগান করার আনুষঙ্গিক মশলাপাতির নাম-গোত্র ও জোগান-ও যদি সেখান থেকেই পাওয়া যায়, ক্রস মার্কেটিং-এর শিকার হচ্ছে বুঝেও মোটের ওপর ডিলাইটেড-ই হয় সে। দিনকয়েক আগে সকাল ৭টায় আমার ঘুম ভাঙ্গিয়ে বিগবাস্কেট জানিয়েছে, যে আমার অর্ডার করা হাফ কিলো পটল তারা বাড়িতে পৌঁছে দিচ্ছে বটে, কিন্তু পটলের কোয়ালিটি একটু কম ভালো বলে তারা দামটা পুরোই ফেরত দিচ্ছে। ২-৩ টি বাদে বাকি পটল দিব্যি ঠিকঠাক ছিল, অতএব রাতে পিকুকে পটলভাজা খাওয়াতে খাওয়াতে আমি পুনরায় ডিলাইটেড।
যে কোন প্রোডাক্টের কথা কল্পনা করে তার ফিচারগুলিকে এই ৩টি ক্যাটেগরিতে ভাগ করে ফেলুন, মার্কেট ধরতে হলে কি কি ইনিশিয়াল ফিচার আপনার প্রোডাক্টে থাকা উচিত সেটা বোঝা খুব সহজ হয়ে যাবে।
অতঃপর, চতুর্থীর দিন সকাল সকাল আরও ৩১ টি আইটেমের সাথে বাড়িতে এসে পৌঁছল আরবান টেরার বীজ, পটিং মিক্স ও অরগানিক কমপোস্ট। ঠিক করা হল, প্যাকেটের ওপর বেশ করে ডেটল স্প্রে করে দিনতিনেক সেগুলিকে বারান্দায় ফেলে রাখা হবে। ষষ্ঠী থেকে পিকুর স্কুল ছুটি, সেদিনের জন্য ওর দায়িত্ব ১০ টা দইয়ের ভাঁড় রঙ করা। সপ্তমী তে মাটি তৈরি ও বীজ বপন। পিকু এক্সাইটেড, তার মাম্মাও কম এক্সাইটেড নয়। চোখের সামনে ভাসছে রঙিন নাইন-ও-ক্লক ফুলের দল।
যেমনটা ভাবা, তেমনটাই কি হল সত্যি সত্যি? সে গল্প হোক পরের পর্বে। আজকের মতন এখানেই ইতি।
(অন্তরা, 6-Nov-2020)