সুতো
সুতোয় বাঁধা থাকি আমরা, একে অপরের সাথে… জানেন? অথচ সম্পর্ককেও আমরা বাক্সে ভরি, বাক্সে ভরে লেবেল আঁটি, আর সব কিছুর মতোই।
“এ আমার পুরোনো পাড়ার প্রতিবেশী”, “এর সাথে অঙ্কের স্যারের কাছে পড়তে যেতাম — কমন ব্যাচ”, “ইনি এক্স-কলিগ”, “এ কলেজ সিনিয়র”…. ইত্যাদি। কিন্তু এই অতি সাধারণ সম্পর্কগুলোরই ক্রস-সেকশন নিয়ে স্লাইড বানিয়ে মাইক্রোস্কোপের তলায় ফেলে দেখবেন কখনো… দেখবেন কত অজানা রঙের সুতোর সমাহার। আপনি হয়তো জানতেনই না, যে এসব রঙ আপনার পৃথিবীতে আছে, বা ছিল কখনো।
এ বছর গ্রীষ্মে বাড়ি গিয়েছিলাম মাসখানেকের জন্যে। তুতাদিদির সাথে দেখা হল। তুতাদিদি কে? “এক্স-নেবার” অ্যান্ড “ফার্স্ট ফ্রেন্ড”। ৬ মাস বয়সে আলাপ। তুতাদিদির বোধহয় তখন চার বছর। আমাদের বাবারা কলকাতা মিউনসিপ্যালিটির ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন, প্রায় একই সাথে জয়েন করেছেন, এক-দু বছর আগেপরে রিটায়ারমেন্ট। বহুবছরব্যাপী সহকর্মী। ব্যারাকপুরে গঙ্গার ধারে চমৎকার ফ্ল্যাটে থাকতাম আমরা। ইন্দিরা গান্ধী ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট ক্যাম্পাসের অন্তর্ভুক্ত রেসিডেনসিয়াল কোয়ার্টার। তুতাদিদিদের ফ্ল্যাট নম্বর এ-থ্রি। আমাদের এ-ফোর। দোতলা। দুজনেই একই উচ্চতা থেকে গঙ্গার বয়ে যাওয়া দেখতাম রোজ।
তুতাদিদির বাড়িতে মাংস রান্না হলে আমি গন্ধ পেয়ে হামাগুড়ি দিয়ে ওদের বাড়ি যেতাম। তারপর রান্নাঘর থেকে খালি বাটি নিয়ে এসে ঠায় বসে থাকতাম ওদের সোফায়, কখন দুটো পিস পাব। আমার জ্বর হলে তুতাদিদির মা — রানু কাকীমা, আমার নানু, বাড়িতে এসে মাথায় জলপট্টি দিয়ে দিত। তুতাদিদির রেড-টাই রেড-বেল্ট হোয়াইট ফ্রক স্কুল ইউনিফর্মের মোহে পড়ে আমার অন্য স্কুল বাদ দিয়ে মডার্ন স্কুলে ভর্তি হওয়া। তুতাদিদির পদবীর প্রতি হিংসুটেপনা করে আমার বড় হয়ে কোন এক “সরকার” কে বিয়ে করার ইচ্ছে জাগা।
এমন কি মান্ধাতা আমলের অডিও ক্যাসেটের সেট ফেলে দেওয়ার আগে পর্যন্ত, রেকর্ডেড আদো আদো বুলিতে আমি তুতাদিদিকেই খুঁজেছি বারেবারে — “দিদিয়া তই? দিদিয়া?”
এই হেন তুতাদিদির সাথে আমার অনেক সুতোয় জড়িয়ে থাকারই কথা। কিন্তু সেসব সুতোর কথা মনে করার, তাদের বাঁচিয়ে রাখার সময় কই আমাদের? বড় ব্যস্ত জীবন। তারওপর দশ পেরোতেই আমাদের পাড়া আলাদা, স্কুল আলাদা, ধীরে ধীরে পড়াশোনার ক্ষেত্র আলাদা, সমস্যা আলাদা, সমাধান আলাদা, আর ২০১০ থেকে তো রাজ্যও আলাদা।
তবে গত সাড়ে সাত বছর ধরে একটা এক্কেবারে নতুন সুতোয় বাঁধা পড়েছি আমরা — তুতাদিদি আর আমি প্রথম মা হয়েছি জাস্ট এক মাস আগে পরে। এখন বছরে-দু বছরে একবার অন্তত দেখা হয় আমাদের আর আমাদের ছানাদের।
এ বছরও হল। এপ্রিলের মোষগরমে। কথায় কথায় সেই ছোট্টবেলার বইদুনিয়ায় চলে গেলাম আমরা। তুতাদিদির দারুন সুন্দর সুন্দর ইংলিশ চিলড্রেনস বুক ছিল এককালে, পাতাজোড়া পপ-আপ থাকত সেসব বইয়ে। কেমন ম্যাজিকের মতন উঠে আসত তারা বই খুললেই! কেমন ক্যাসেল, প্যালেস, ফোর্ট তৈরি হয়ে যেত চোখের সামনে, ধাঁ করে! আবার বই বন্ধ করলেই উধাও!
আর লেডিবার্ড পাবলিকেশনের ফেয়ারি টেলসের বইগুলোয় কি অসাধারণ ভাল ইলাস্ট্রেশন থাকত, আহা! স্নো হোয়াইট অ্যান্ড দ্যা সেভেন ডোয়ারফস, স্লিপিং বিউটি, সিন্ড্যারেলা, হ্যান্সেল অ্যান্ড গ্রেটেল…. ঠিক অমনটি আর পাইনা এখন… কেন যে পাইনা!
“হ্যাঁ তুতাদি, বুকশপে কত খুঁজি আমি! দেখি লেডিবার্ড-এরই বই, কিন্তু কি বাজে ইলাস্ট্রেশন এখন! দুঃখ লাগে, কি দুঃখ লাগে দেখে।”
“হ্যাঁ পাপাই, কি চড়া রঙ ব্যবহার করে এখন! দেখেই কেমন লাগে! দুঃখ লাগে রে, দুঃখ লাগে খুব।”
দেখা যায়, কি অবাক কান্ড ভাবুন, দেখা যায়…. যে আমি আর তুতাদিদি কেউই গত সাড়ে সাত বছরে বাচ্চাদের জন্য ইংলিশের ট্র্যাডিশনাল ফেয়ারি টেলসের বই কিনে উঠতে পারিনি। কিনতে চেয়েছি, দোকানে গিয়েছি, হাতে নিয়েছি বারেবারে। কিন্তু আশাহত হয়ে নামিয়ে রেখেছি। অন্য বই কিনেছি। অন্য চরিত্র, অন্য গল্প সেখানে।
পৃথিবী জুড়ে এখন অসাধারণ চিলড্রেনস বুকের সমাহার। ভারি বুদ্ধিদীপ্ত, ভারি রঙিন মন নিয়ে করা সেসব কাজ। সেসব কাজ এসেছে বইকি আমাদের বাড়িতে। থরে থরে এসেছে। কিন্তু ফেয়ারি টেলস আসেনি। এক অদ্ভুত বিষন্নতার মেঘ ছড়িয়েছে আকাশে, প্রতিবার। সে মেঘের এক প্রান্ত ব্যাঙ্গালোরে, এক প্রান্ত ব্যারাকপুরে, খড়দায়, সিঁথির মোড়ে। সে মেঘ ধরা দিয়েছে শুধু আমাদের দুজনের চোখে… একে অপরের অজান্তেই। তৃতীয় কেউ তার হদিশও পায়নি।
আমার কেমন মনে হল, জানেন, যে আমার আর তুতাদিদির মধ্যে হাজার খানেক সুতোর মধ্যে এখন এই সুতোটা, এই ভীষণ সরু মনখারাপি সুতোটাই, সবচেয়ে জীবন্ত। মানে, এটাই সবচেয়ে, এবং প্রশ্নাতীতভাবে, অপ্রয়োজনীয় কিনা…
- অন্তরা (১৯-জুন-২০২৩)
(ছবি: ১৯৮৯-এর জন্মদিনে তুতাদিদির থেকে আমার গিফট পাওয়া লেডিবার্ড পাবলিকেশনের ফেয়ারি টেলসের বই। এ বছর পিকু পড়তে শুরু করল এই বইগুলো।)