খাদ্যান্বেষী ৮
মিটবল পর্ব: ২৪ই জুন, শুক্রবার, সময় ৫:০০, বেঙ্গালুরুর স্বগৃহ:
স্টকহোম যাইবার পূর্বে দক্ষিণ ভারতীয় সহকর্মীটিকে খাদ্যের ব্যাপারে জিজ্ঞাসিয়াছিলাম। সে নিরামিষাশী নহে, ইতিপূর্বে ওই স্থানে গিয়াছে। সুইডেনের কোন বিশিষ্ট খাদ্য স্টকহোমের কোন বিশিষ্ট রেস্তোরাঁয় খাওয়া অবশ্যকর্তব্য, ইহাই জানিবার ছিল আমার।
তো সেই লোক আমার হোটেলের নামধাম শুনিয়া, গুগল ম্যাপে দেখিয়া, ভাবিয়া চিন্তিয়া কহিয়াছিল — “তোমার হোটেল হইতে স্বল্প দূরত্বে একটি ভারতীয় রেস্তোরাঁ আছে। খাদ্যের স্বাদ ভাল নহে, তবু খাইতে পারো।”
সবিনয়ে জবাব দিয়াছিলাম “দেশের বাহিরে গিয়া আমি কি মরিতে দেশীয় খাদ্য খাইব? সুইডিশ খাদ্যের কথা কহ আমারে। আচ্ছা, নিদেনপক্ষে কোন বিশেষ কেক, ডেজার্ট, মায় বিশেষ কফিশপের বিশেষ কুকিবিস্কিটের কথা স্মরণে থাকিলে তাহাও কহ।”
মোহন মাথা চুলকিয়া একটি কাবাব জয়েন্টের খবর দিয়াছিল। আমি সম্ভবতঃ ভদ্রতার সহিত দাঁত মুখ খিঁচাইয়াছিলাম। নূতন চাকুরী, নূতন সহকর্মী, বুঝিয়া চলিতে হয়। আলোচনা ওখানেই স্থগিত হইয়াছিল।
ফিরিবার দিন তিনেক পর মোহনের সাথে কথা হইল। স্টকহোমে কি হইল তাহা জানিতে সে খুব উৎসাহী। আমারও উৎসাহের অভাব নাই। তাহাকে রৌদ্রঝলমল আবহাওয়ার গল্প বলিলাম, অপরূপ সুন্দর ক্যানালের ধার দিয়া দিয়া পায়ে হাঁটিয়া কত বেড়াইয়াছি সেই গল্প বলিলাম, কি খাইয়াছি না খাইয়াছি তাহার বিশদ বিবরণ দিলাম।
সে শান্ত মুখে শুনিল। মাথা নাড়িল। এবং কহিল “যে কনফারেন্সটির উদ্দেশ্যে গমন করিয়াছিলে, সেখানে কি হইল, এক্ষণে সে কথা কিছু কহিবে কি, মা জননী?”
না, “মা জননী” টি সে সোচ্চারে বলে নাই। তথাপি আমি শুনিতে পাইয়াছি। কি আর কহিব, বিড়ম্বনার সহিত সখ্যতা আমার চিরকালীন।
ভাগ্যক্রমে, নম্রতা অমন বেরসিক নহে। নম্রতা হইল আমাদিগের কলেজের সেই ডাকাবুকো জুনিয়র মেয়েটি, যে প্রথম বর্ষে সামান্যের জন্য ‘মিস ফ্রেশার’ হওয়া মিস করিয়াছিল। (সম্ভবত সেই ক্রোধ হইতে) সে পরবর্তীকালে ওই ব্যাচেরই ‘মিস্টার ফ্রেশার’-টিকে বিবাহ করিয়া সুইডেনে স্থিতু হয়। এক্ষণে উহাদের দুইটি অতি মিষ্ট পুত্র ও পুত্রী বর্তমান। তাহারা সুইডিশ স্কুলে যায়, সুইডিশ ও ভারতীয় দুই সমাজ ও সংস্কৃতিতেই অনায়াসে সন্তরণ করে, এবং মাতাপিতাপুত্রপুত্রি সকলেই ঝড়ের মতন সুইডিশ কহে।
১৫ বৎসর বাদে সাক্ষাৎ হইল সেই নম্রতার সাথে। আমি যেইদিন পৌঁছিয়াছি, তাহার পরদিন, অর্থাৎ মঙ্গলবার, সে অফিসফেরত দেখা করিতে আসিল আমার সাথে। আমার নিকট (আমারই পীড়াপীড়িতে) সে সামান্য আবদার করিয়াছিল — পারিলে কিছু বাঙ্গালা পত্রিকা ও পুস্তক লইয়া যাইতে হইবে। সেই আবদার মিটাইয়াছি। গুটিকতক সানন্দা, দেশ, আনন্দলোকের সহিত আমার অন্যতম প্রিয় ছোট গল্পের বই ‘নির্বাচিত পোস্টকার্ড গল্প’ তাহার হাতে ধরাইয়া আসিয়াছি। সেও আমার আবদার ভরিয়া ভরিয়া মিটাইয়াছে। সারা বিকাল, সারা সন্ধ্যা জুড়িয়া সে আমাকে স্টকহোম দেখাইয়াছে, সুইডিশ সমাজ ও তাহার ক্রমপরিবর্তনের নানান গল্প শুনাইয়াছে, আমি সেলফি তুলিতে তুলিতে বোর হইয়াছি শুনিয়া দায়িত্ব লইয়া গাদা ফটো তুলিয়া দিয়াছে, এবং অবশেষে লইয়া গিয়াছে Bistro Bestik নামক চমৎকার একটি রেস্তোরাঁয়।
স্বল্পালোকিত সেই রেস্তোঁরায় এত খাদ্যরসিকের সমাগম যে অ্যাডভান্স বুকিং ব্যতীত সিট মেলা ভার। ঢুকিলে এক লহমায় আপনি বুঝিবেন যে ওই স্থান ট্যুরিস্টদের জন্য নহে। উহার মেনু সুইডিশে লেখা। উহার ওয়েট্রেসগণ উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায়, হাসিয়া আপন করিয়া কথা কহে — কিন্তু সকলই সুইডিশে।
নম্রতাকে কহিলাম “এই মেনু উদ্ধার করিবার সাধ্য আমার নাই। সুইডেনের নিজস্ব খাদ্য খাইব। তুই বুঝিয়া অর্ডার কর।”
নম্রতা রেড ওয়াইন সহযোগে বিস্ত্রোর হ্যাণ্ড-রোল্ড মিটবল খাওয়াইল। অতি স্বাদু মিটবলের সাথে আসিল ক্রিম সস, সেদ্ধ আলুর পিউরি, পিকলড কিউকাম্বর (জারিত শশা?) ও এক ছোট বাটি ভর্তি লাল টুকটুকে রসালো লিঙ্গনবেরি। বেঙ্গালুরুর সুপারমার্কেট ও বিগবাস্কেট, আমাজন ইত্যাদির সুবাদে রাস্পবেরি, ক্র্যানবেরি, গোজিবেরি ইত্যাদি অনেক রথী-মহারথীদের সাথেই আগে সাক্ষাৎ হইয়াছে, কিন্তু
লিঙ্গনবেরির নাম ইতিপূর্বে কদাপি শুনিনাই। বেদানা ভাবিয়া ভুল করিয়াছিলাম। খাইলাম। ভুল ভাঙ্গিল। বেশ লাগিল। শখ মিটিল, অন্তত সেইদিনকার মতন।
সুদূর সুইডেনে বসিয়া, সুদূর সুইডেনে মিশিয়া, কর্পোরেট চাকুরী, দুইটি ছানা, ছোট্ট সব্জিবাগান, না জানি আরো কত্ত কিছু সামলাইয়া নিতান্ত শখে একটি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট গ্রুপ চালাইতেছে যে দুরন্ত দাপুটে মেয়েটি, তাহাকে ঠিকমতন থ্যাংক ইউ জানাইয়াছিলাম তো সেইদিন?
কি জানি! অত কিছু কি স্মরণে থাকে, অত কিছু খাইবার পর?
তাহা হইলে আজ জানাই?
থ্যাঙ্ক ইউ, নম্রতা! আবার যদি ১৫ বৎসর পর দেখা হয়, ঠিক এইরকমই যেন দেখি তোকে!
লেখা ও ছবি: নিজস্ব
আগের পর্ব: খাদ্যান্বেষী ৭. Food blog by a hungry hippo on an… | by Antara Kundu | Aug, 2022 | Medium