অথ গার্ডেনিং গাথা (পর্ব ৩)
ষষ্ঠীর দিন সকাল থেকে হৈ-হৈ কাণ্ড। পিকু ঘুম থেকে উঠে পড়েছে তাড়াতাড়ি, ‘পট’ রঙ করতে হবে। আগের দিন রাত থেকেই সে তৈরি। তাড়াহুড়ো করে ব্রাশটা করেই দিদুনকে স্পষ্ট জানিয়ে দিলো, ব্রেকফাস্ট- টেকফাস্ট যেন তাকে না দেওয়া হয়, আজ তার অনেক কাজ। অনেক কষ্টে ‘খাবার নে খেয়ে রঙে হাত দেওয়া যাবে না’ গোছের ব্ল্যাকমেলের আশ্রয় নিয়ে দুটো বিস্কিট খাইয়ে তাকে সরঞ্জাম হ্যান্ড-ওভার করতে বাধ্য হলাম। সরঞ্জাম কি? ৮টা মিষ্টি দইয়ের ভাঁড়, ৬টা অ্যাক্রিলিক কালারের বোতল, ২টো তুলি, রঙের হাত মোছার কাপড়, ও মাদুর। ইন্সট্রাকশন অতি সামান্য — “যেভাবে খুশি রঙ কর বাপ, তবে রঙ যেন পটের ওপরেই পড়ে সেটা শুধু দেখিস।” এই কাতর প্রার্থনার একটা প্রেক্ষাপট আছে। মাস দুয়েক আগে দুটো ভাঁড়ে ছোলা গাছ বুনেছিলাম মনে আছে? সেই ভাঁড়ও পিকুই রঙ করেছিলো। এবং আমার দশ মিনিটের অনুপস্থিতির পরিণামে ভাঁড় ছাড়াও সেদিন রঙ হয়েছিল আমাদের ডাইনিং টেবিল, গদিশুদ্ধু চেয়ার, বেসিন, ফ্লোর টাইলস এবং সে নিজে — মাথা থেকে পা অব্দি। গোল্ডেন, গ্রিন ও ব্লু মেটালিক ফিনিশ অ্যাক্রিলিক কালারের সৌজন্যে স্বর্ণমণ্ডিত, পান্নাজহরত-খচিত বাড়ি ও ছানা দেখে ভারী কান্না পেয়েছিল সেদিন, এবং এদের পরিষ্কার করতে বাড়ির সবাইকেই যথেষ্ট শ্রম ব্যায় করতে হয়েছিল।
আজ তাই বাথরুম-তাথরুম কোথাও না গিয়ে গ্যাঁট হয়ে বসে রইলাম তার পাশে। এবং অবাক হয়ে দেখলাম, পিকু কি ভীষণ মন দিয়ে রঙ করছে প্রত্যেকটা পট। কোথাও লালের পাশেই উজ্জ্বল সবুজ, কোথাও লাল আর ঘন নীলের কোলাকুলি। কালার ব্যাল্যান্স নিয়ে কোন মাথাব্যাথা নেই, ডিজাইন আর প্যাটার্নের নিকুচি করে পৃথিবীর মানচিত্র, ড্যাবড্যাবে চোখওয়ালা ভূতের মুখে সজ্জিত হয়ে হয়ে উঠছে একের পর এক পট, এবং বে-এ-এ-শ লাগছে তাদের দেখতে। পিকুকে শেখানোর জন্য আমি একটা পট রঙ করতে গিয়েছিলাম, সিম্পিল লাল আর শাদা হরাইজনটাল ব্যান্ড-এর প্যাটার্ন ইউজ করে। পিকুর পটগুলোর পাশে এতটাই বোরিং দেখতে হল সেটা যে আমি ‘মেনটরিং মোড’ থেকে সোজা সুইচ করলাম আমার প্রিয় ‘অবজারভার মোডে’।
গোল বাঁধল শেষ দুটো পটের ক্ষেত্রে। ততক্ষণে পিকু পটের গায়ে ডিরেক্ট কালার অ্যাপ্লাই করার খেলাটায় নিজেকে সিদ্ধহস্ত জ্ঞান করে পরের লেভেলে মুভ করার ডিসিশন নিয়ে ফেলেছে। পরের লেভেল অর্থাৎ প্যালেটে কালার মিক্সিং। এবং আমার চোখের সামনেই সে যাবতীয় রঙের বোতলে একই তুলি ডুবিয়ে এক গাদা করে রঙ তুলে একটা বাটিতে মিশিয়েও ফেলেছে। আমার হাউমাউতে তেমন কিছু যায় আসেনি তার। এর ফল হল চার রকম। প্রথমত, শাদা এবং হলুদ রঙের বোতলগুলো আর কহতব্য অবস্থায় রইল না, বাকি রঙ গুলোরও মোটামুটি বারোটা বাজল। দ্বিতীয়ত, পিকু প্রবল বিস্ময়ের সাথে রিয়ালাইজ করল যে কালার মিক্স করলে নতুন কালারের সৃষ্টি হয়, এবং সব কালার মিশিয়ে দিলে যেটা দাঁড়ায় সেটাকে কালোই বলা যায়। তৃতীয়ত, আমি পিকুকে পিগমেনট আর লাইটের ক্ষেত্রে কালার মিক্সিং-এর ডিফারেন্সের ব্যাপারে একটু জ্ঞান প্রদান করার সুযোগ পেলাম। চতুর্থত, শেষ দুটো পটের রঙ হল ঘুটঘুটে অন্ধকার।
যাহোক, রঙ করার পালা শেষ। পটগুলোকে বারান্দার কড়া রোদে শুকোতে দেওয়া হল। পূজার অ্যাজেনডার নেক্সট পয়েন্টস কি কি?
- নতুন পটগুলোর তলায় ড্রিল করে জল বেরোনোর ফুটো তৈরি করা।
- আগের দুটো পট থেকে শুকিয়ে যাওয়া ছোলা গাছ উৎখাত করে গ্যাঁদগ্যাঁদে কাদামাটি পরিষ্কার করা।
- নতুন মাটি তৈরি করা।
- পোরটুলাকার বীজ বপন।
এর মধ্যে প্রথম কাজটা করানো হবে লাইফ পার্টনারকে দিয়ে। বাকি সব কিছুর প্রাইমারি দায়িত্ব পিকুর। আমার রোলটা হবে স্ক্রাম মাস্টারের। এই স্ক্রাম মাস্টার ব্যাপারটা বেশ মজার। সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, এবং তার বাইরেও অনেক ইন্ডাস্ট্রিতে অ্যাজাইল ডেলিভারি মডেল ফলো করা হচ্ছে অন্তত বছর দশেক ধরে। ৭ থেকে ৯ জনের ছোট্ট ডেভেলপমেন্ট টিম যথাসম্ভব স্বাধীনভাবে কাজ করে অ্যাজাইলে, আর তাদের মধ্যে কোঅরডিনেশন বজায় রাখার দায়িত্বে থাকে একজন স্ক্রাম মাস্টার। সে ইনডিভিজুয়ালি কোন স্পেসিফিক টাস্ক টেক-আপ করেনা, কিন্তু বাকি ডেভেলপারদের হেল্প করা, তারা কাজের ক্ষেত্রে কোন সমস্যার সম্মুখীন হলে সেটা সল্ভ করা, নানাধরনের এক্সটারনাল প্রেশার থেকে তাদের গার্ড করা, সর্বোপরি ‘অ্যাজ আ টিম’ তারা যাতে যথাসময়ে কাজটা কমপ্লিট করতে পারে সেটা দেখা স্ক্রাম মাস্টারের দায়িত্ব।
আমার ছোট্ট ডেভেলপমেন্ট টিমে সর্বসাকুল্যে সওয়া একজন ডেভেলপার — পিকু, এবং পার্ট টাইমার হিসেবে লাইফ পার্টনার। লাইফ পার্টনারকে আবার এই ক্ষেত্রে সমঝে চলতে হয়, গার্ডেনিং-এ তার তেমন ইন্টারেস্ট নেই, বেশি কাজ চাপিয়ে দিলে সে বিদ্রোহ ঘোষণা করে টিম ছাড়তে পারে। বাড়ির গাবদা ড্রিলিং সেটটির ব্যাপারে নেহাত আমার বিশেষ ভীতি আছে বলেই তার দ্বারস্থ হওয়া।
সপ্তমীর দিন মাটি তৈরি হল ‘আরবান টেরা’-র ইন্সট্রাকশন মেনেই। ‘পটিং মিক্স’-এর সাথে এক কাপ ‘অরগানিক কমপোস্ট’ ভালো করে মিশিয়ে ১০টা পটে সেটা ভাগ করে দিয়ে পার পট ২-৩টে করে পোরটুলাকার বীজ ছড়িয়ে দিলাম। পোরটুলাকার বীজ হ্যানডেল করা খুব একটা সহজ নয় মোটেও, কারণ তাদের সাইজ পোস্ত দানার মতো। একটু জোরে নিঃশ্বাস ফেললেই তারা উড়ে যায়, একবার মাটিতে পড়লে আর চোখেই দেখা যায় না। যাহোক, ছোটমামার কথামতন বীজের ওপর হাল্কা করে মাটি ছড়িয়ে সামান্য জল ছিটিয়ে দিলাম। ছোটমামা বলেছে বেশী জল পেলে বীজ পচে নষ্ট হয়ে যাবে, আর মাটির বেশী নীচে চলে গেলেও মুশকিল, বীজ জারমিনেট করবে না।
গোটা ব্যাপারটায় আমার প্রাইমারি ডেভেলপারের ইনভল্ভমেনট ছিল দেখার মতন। প্রথমে ব্যাটা কমপোস্ট-এর গন্ধে নাক-টাক কুঁচকে পালানোর চেষ্টা করেছিল বটে, তবে সে চেষ্টা সাকসেসফুল হয়নি। শেষ পর্যন্ত হাত না লাগিয়ে চামচ দিয়ে সব কাজ করবে, এই শর্তে পুরোটা সময়ই সে সঙ্গ দিলো, আর কাজও করল বিস্তর। নবমীর দিন আবার সওয়া একজন ডেভেলপার মিলে বেশ একটু সারপ্রাইজ দিলো আমাকে। সকালবেলা নতুন জুতো কিনতে বেরিয়ে তারা একটা ওয়াটার স্প্রেয়ার কিনে নিয়ে এলো। খুশি-ই হলাম বেশ।
এবার অপেক্ষা স্যাপ্লিং বেরোনোর। ‘আরবান টেরা’ বলছে ১ থেকে ২ সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে সিড জারমিনেশনের জন্য। ততদিন কাজ বলতে শুধুই একটু একটু করে জল দিয়ে যাওয়া, আর মাটি যাতে ঠিকমতন আলোবাতাস পায় সেটা দেখা। জল দেওয়ার কাজটাও রোজ পিকুই করছে, আমার তদারকিতে। মাটি যাতে কোনভাবেই কাদা-কাদা না হয়ে যায় দেখতে হবে তো। পিকু কোনদিন অন্যদিকে ব্যাস্ত থাকলেও আমার জল দেওয়ার হুকুম নেই, বাড়িতে লঙ্কাকাণ্ড বাঁধাবেন আমার পঞ্চবর্ষীয় হনুমান মহোদয়। ব্যাপার মন্দ নয়!
যাহোক, নির্দিষ্ট সময়মতন স্যাপ্লিং বেরোল কি আদৌ? ৩০টা বীজের মধ্যে জারমিনেট-ই বা করল কটা? সবটা বলছি পরের (এবং সম্ভবত শেষ) পর্বে। আজ এতটাই থাক।
(অন্তরা, 15-Nov-2020)