অথ গার্ডেনিং গাথা (পর্ব ১)
এবারের দুর্গা পূজায় প্যান্ড্যাল-হপিং নাস্তি, সেটা আগে থেকেই ভাবা ছিল। বন্ধুদের সাথে ক্যাচ আপ-ও নৈব নৈব চ। করোনার কল্যাণে সবারি বাড়ির দরজা বন্ধ, এবং মনের দরজা শুধুমাত্র ফোন, হোয়াটসঅ্যাপ বা জুম কলের থ্রু তে অ্যাক্সেসিবল। ব্যাক্তিগত ভাবে আমার জন্য সেটা সামান্য শিরঃপীড়ার সৃষ্টি করলেও, ভালো অল্টারনেট প্ল্যান সহজেই সেই পীড়ার উপশম ঘটাতে পারে। আর লাইফ-পার্টনারটি পূজায় না বেরোতে পারলেই বেঁচে যায়।
মনে আছে, বিয়ের পর প্রথম পূজা আমরা অতি আনন্দে কাটিয়েছিলাম। সালটা ২০১১। মাস দুয়েক হল বিয়ে হয়েছে। ব্যাঙ্গালোরে একটা ছোট ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকি দুজনে, আর একই অফিসে চাকরি করি। পূজায় কলকাতা যাওয়ার কোন চেষ্টাই করিনি, এবং দশেরায় প্রাপ্য এক দিনের ছুটির বাইরে কোনও এক্সট্রা ছুটির জন্যেও অ্যাপ্লাই করিনি। মনের সুখেই অফিস করতাম রোজ, আর তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে বোর্ণ-সিরিজের ফিল্ম দেখতাম একটা করে। সপ্তমীতে ‘দা বোর্ণ আইডেন্টিটি’, অষ্টমীতে ‘দা বোর্ণ সুপ্রিমাসি’ আর নবমী তে ‘দা বোর্ণ আল্টিমেটাম’। ‘দা বোর্ণ লিগাসি’ আর ‘জেসন বোর্ণ’ বোধহয় রিলিজ করেনি তখনও। সাজুগুজু আর ঠাকুর দেখা? মারো গোলী!
প্রাক-ছানা যুগে যে কোনও ছুটির জন্য আমাদের প্ল্যানিং মোটামুটি এই ধরনেরই হত — নেটফ্লিক্স কি হটস্টার থেকে কোন রোমহর্ষক সিরিজ দেখা, তার সঙ্গে কোন অনলাইন কোর্স কি স্টাডি মেটেরিয়াল কমপ্লিট করা, অনেকদিন ধরে ফেলে রাখা কোন গল্পের বই পড়ে ফেলা, এবং ল্যাদ কাটিয়ে উঠতে পারলে পার্সোনাল ব্লগে কিছু লেখালিখির চেষ্টা।
সেই যুগ শেষ হয়েছে প্রায় বছর পাঁচেক আগে। আমাদের উইক-এন্ড, ভ্যাকেশন, কাজের দিনের টুকরো ফ্রি-টাইম সবই এখন পিকুর সম্পত্তি। সে দাবীর সবটাই ন্যায্য না একটু অন্যায্য সে তর্ক বৃথা। মোট কথা, ছুটির প্ল্যানিং-এ পিকু কে ভুলবশতও ইগনোর করা হলে পরিনাম হয় যথেচ্ছ ট্যাঁ-ভ্যা সহযোগে এক বিতিকিচ্ছিরি খিচুড়ি। অতএব, এই অভূতপূর্ব সময়ে, ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ করোনা-অধ্যুষিত রাজ্য কর্ণাটকে বসে পূজার প্ল্যানিং করতে গিয়ে প্রচুর মাথা খাটিয়ে বেস্ট অপশন বেরোল গার্ডেনিং।
হ্যাঁ, গার্ডেনিং, যাতে পিকুর আর আমার এক্সপেরিয়েন্স লেভেল মোটামুটি সেম টু সেম। মাস দুয়েক আগে দুটি মিষ্টি দইয়ের ভাঁড়ে মাটি ফেলে খান কয়েক অঙ্কুরিত ছোলা বুনেছিলাম আমরা দুজন, এবং আল্টিমেটলি আমাদের মুখ উজ্জ্বল করে সেই ছোলা থেকে শুধু গাছ-ই বেরয়নি, সেই গাছে চারটি ছোলাও ধরেছিল। অতএব এইবারে উই ওয়্যার রেডি ফর দা নেক্সট বিগ চ্যালেঞ্জ! সমস্যা হল দুটি। প্রথমত, আমাদের টব বলতে সর্বসাকুল্যে দশ টি মিষ্টি দইয়ের ভাঁড়, তার এক-একটি তে দুশো গ্রাম দই ধরে। আর মাটি বলতে মায়ের করা অ্যালো ভেরা গাছের টবের মাটি। বাড়ির বাইরে পা না দিয়ে এর চেয়ে বেশি রিসোর্স সংগ্রহ করা সম্ভব কি না তখনও জানিনা। দ্বিতীয়ত, দইয়ের ভাঁড়ে ছোলা ছাড়া আর কি গাছ করা সম্ভব সে সম্পর্কে কোন ধারনা নেই। মা বলল, আলু ট্রাই কর, বা পেঁয়াজ। হিসেব কষে দেখলাম, ওই সাইজের ভাঁড়ে মাটি এবং আলু/পেঁয়াজের সহাবস্থান কোনক্রমেই সম্ভব নয়। এবং আমার লাগানো আলুগাছে যদি দু-তিনটি আলুও না ধরে, তাহলে আর গাছ লাগানো কেন? পিকুর তরফ থেকেও কিছু সাজেশন এলো বটে, কিন্তু তার কোনটি-ই ইমপ্লিমেন্টেবল নয়।
এবার ফোন গেল উত্তরবঙ্গের ‘সেনসাস টাউন’ শামুকতলায়। ‘সেনসাস টাউন’-এর কনসেপ্ট টা ছোট্ট করে বলে রাখি এখানে। এটি এমন একটি জায়গা যা অফিশিয়ালি টাউন হিসেবে চিহ্নিত হয়নি এখনও, অথচ পপুলেশন, পপুলেশন ডেনসিটি এবং নন-এগ্রিকালচারাল সেক্টরে এমপ্লয়মেন্টের নিরিখে সে জায়গা টাউনের সমতুল্য। ভারতবর্ষে এরকম ‘সেনসাস টাউন’ বেশ কিছু আছে, যেমন ঝাড়খণ্ডের ঘাটশিলা, বা উত্তর প্রদেশের গ্রেটার নয়দা, বা পশ্চিমবঙ্গের বেগমপুর বা চিত্তরঞ্জন। যাহোক, শামুকতলায় থাকে আমার ছোটমামা। এক্স-অডিটর, অধুনা বীজ, সার, কীটনাশক ইত্যাদি এগ্রিকালচারাল প্রোডাক্টের ব্যবসায়ী, গার্ডেনিং-বিশেষজ্ঞ, এবং শখের বার্ড-ফোটগ্রাফার আমার ছোটমামা। তো ছোটমামা সব শুনে বলল “কোন ব্যাপার নয়, নাইন-ও-ক্লক কিংবা ইনকার চারা কিনে বুনে ফ্যাল। সিজনাল ফুলের গাছ, বেশী ঝঞ্ঝাট নেই, সূর্যের আলো আর রেগুলার জল পেলে ছোট টবেও দিব্যি ফুল হবে।” নাইন-ও-ক্লক-এর আরেক নাম পোরটুলাকা। গোলাপি, লাল, হলুদ , কমলা, ল্যাভেন্ডার, সাদা ইত্যাদি নানা রঙের ফুল ধরে এই গাছে। বাগান, সাইড ওয়াক বা পার্কের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য অসাধারণ। সকাল নটা থেকে এগারোটার মধ্যে ফুলগুলি ফোটে, তাই নাইন-ও-ক্লক, ইলেভেন-ও-ক্লক ইত্যাদি নামে পরিচিত এই গাছ। ইনকা আবার এক ধরনের মারিগোল্ড বা গাঁদা ফুল, আমাদের দেশে শীতের ফুল হিসেবে খুবই কমন।
সেসব তো হোল, কিন্তু এই করোনামুখর সময়ে মারাত্মক প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে পা দেবো না, এই পণ ভেঙ্গে আমি নার্সারি তে যাই কি করে? ঠেলাগাড়িতে নানারকম গাছের চারা ও মাটি নিয়ে এক ছোকরা মাঝেসাঝে আসে বটে, কিন্তু তার জন্য অপেক্ষা করতে বসলে যে দুর্গাপূজা পেরিয়ে কালীপূজা এসে যাবে না তার ঠিক আছে?
অতঃ কিম? সে গল্প না হয় তোলা থাক পরের পর্বের জন্য। আজকের মতন এখানেই ইতি।